ভাইভাতে প্রায় সব সময় একটা প্রশ্ন করা হয়- আপনাকে আমরা কেন নেব? আরও তো অনেক ক্যান্ডিডেট আছে। অনেকে পরীক্ষাতে আপনার চেয়েও ভালো করেছে। তাহলে কী উত্তর দিবেন?
এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রশ্ন। অর্থাৎ এটার কোন সঠিক উত্তর নেই। ভাইভা বোর্ডে যারা থাকেন তারা বুঝতে চান যে আপনি কীভাবে নিজেকে প্রেজেন্ট করেন বা আপনি কি আসলে পজিটিভ মাইন্ডেড লোক নাকি নেগেটিভ মাইন্ডেট। এই প্রশ্নের উত্তরে আপনি আপনাকে তাদের কাছে মার্কেটিং করবেন। ঠিক যেভাবে শাড়ির দোকানে সেলসম্যানরা শাড়ি দেখায়। ধৈর্যশীল হবেন, পজিটিভ উত্তর দিবেন। এমনকি, নেগেটিভ বিষয় গুলোও পজিটিভলি উপস্থাপন করবেন। চলুন দেখি কীভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়-
আপনি যদি ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট হন
১. আপনাকে আমরা কেন নেব? আপনি টিমে কাজ করতে পারেন।
বর্তমানে টিম ওয়ার্ক ছাড়া কোন প্রতিষ্ঠানই চলবে না। কোন একটা কাজ একাই কেউ করতে পারে না। আপনি যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করবেন সেখানে যে ক্লিনার থাকবেন তিনিও আপনার টিমের একটা অংশ। তার সাথে যদি কাজ না করতে পারেন তাহলে আপনার প্রোডাক্টিভিটি কমতে বাধ্য।

সিম্পল একটা উদাহরণ দেই। যেকোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেয়াল করলে দেখবেন ওয়েটার, টেবিল মোছার বয়, পানি দেয়ার লোক, বাবুর্চি, খাবার দেয়ার লোক আলাদা। এরা সবাই মিলে কাস্টমার কে খাবার সরবরাহ করে।
এখন এই টিমের টেবিল মোছার লোকটা যদি বলে টেবিল মোছা আর পানি দেয়ার কাজ সে একাই পারবে – সেটা কম কাস্টমার যখন থাকবে তখন সম্ভব কিংবা যদি টেবিল সংখ্যা কম হয় তখন সম্ভব হবে। কাস্টমার বেশি হলে কিন্তু সম্ভব না। একটা টেবিল মুছতে গেলে অন্য টেবিল থেকে পানি চাইবে। একটা হট্টগোল বাধতে বাধ্য। অর্থাৎ, বড় জটিল কাজ গুলো কয়েক ভাগে ভাগ করে নিলে সেটা সহজে করা যায়।
আবার একটা টিমে বিভিন্ন ধরনের লোক থাকে। তাদের মাথায় ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়া থাকে। এই নতুন আইডিয়া প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কোন একটা সমস্যা সমাধানে ভিন্ন ভিন্ন আইডিয়া নিয়ে চেষ্টা করলে যত সহজে সমাধান পাওয়া যায়, একা একা কাজ করলে ততটা সহজে পাওয়া যায় না।
টিমে কাজ করলে জবাবদিহিতা বাড়ে। সবাই তখন তার নিজের অংশটা নিখুঁতভাবে করতে চায়। যারা কাজে ফাকি দেয়, টিমে কাজ করলে তারা তা পারে না। কেননা, অন্য সদস্যরা তখন তার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলবে।
বড় প্রতিষ্ঠানে তাই টিম ওয়ার্ককে খুব গুরুত্ব দেয়া হয়। আপনি যতই একা একা কাজ করতে পছন্দ করেন না কেন প্রোডাক্টিভিটি ঠিক রাখতে চাইলে টিম ওয়ার্ক মাস্ট। কাজেই কনফিডেন্টলি বলুন, আপনি টিম ওয়ার্ক করতে পারেন।
২. চাপের মধ্যে কাজ করতে পারেন।
প্রাইভেট চাকরির প্রধান বৈশিষ্ট্য- কাজ কখনো শেষ হয় না। কোন একটা কাজ শেষ হতে না হতেই নতুন আরেকটা এসে হাজির। যেমন ধরুন, শীতকালে শীতের কাপড়ের চাহিদা বেড়ে যায়। ফলে এসময় ফ্যাক্টরি গুলোর প্রোডাকশন বাড়াতে হয়। কাজেই চাপ বেড়ে যাবে। আবার অডিটের সময়টা খুবই চাপে থাকতে হয়।

চাপের মধ্যে আপনি পাজল্ড হননা, মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন এটা আপনাকে ভাইভাতে তাই অনেক এগিয়ে দেবে।
৩. শিফট/কাজের সময় নিয়ে আপনার আপত্তি নাই। অভারটাইম করতে পারবেন। প্রয়োজনে নাইট শিফট করতেও সমস্যা নেই।

শিফটিং ডিউটি করতে হয় মূলত ফ্যাক্টরি গুলোতে। সেখানে দিন রাত ২৪ ঘন্টা প্রোডাকশন চলে। আমাদের বেশির ভাগের ধারণা চাকরি মানে ৮-৫টা ডিউটি। ফ্যাক্টরি গুলো সেরকম না। সেখানে ৩ শিফটে কাজ চলে। সেই ক্যান্ডিডেটকেই সবাই প্রায়োরিটি দেবে যে শিফটিং ডিউটি নিয়ে খুতখুত করবে না।
৪. সরকারি চাকরি করার ইচ্ছা নাই। কাজেই আপনাকে নিলে কোম্পানি একটা লম্বা সময় সার্ভিস পাবে।
একটা ফ্রেশ ক্যান্ডিডেট কে ট্রেনিং দিয়ে কাজে দক্ষ করে তুলতে কমপক্ষে ২বছর সময় লাগে। আপনার টার্গেট যদি থাকে সরকারি চাকরি তাহলে বর্তমান চাকরিতে আপনি মনোযোগ দিতে পারবেন না। আবার আপনাকে ট্রেনিং দিয়ে দক্ষ করা হল, এরপর যখন আপনি কোম্পানিকে সার্ভিস দিতে শুরু করবেন ঠিক তখন সরকারি চাকরিতে চলে গেলেন। এতে ঐ কোম্পানির লস। তাই প্রাইভেট সেক্টরের লোকজন সরকারি চাকরির জন্য যারা চেষ্টা করে তাদের ভালো চোখে দেখে না। এমনকি আপনি যদি কোন প্রাইভেট জবে থাকেন আর ম্যানেজমেন্ট যদি জানে যে আপনি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করছেন তাহলে আপনার প্রমোশন হবে না। এটাই স্বাভাবিক। যে চলে যাবে তাকে প্রমোশন দেয়ার কোন মানে নাই। কাজেই ভাইভাতে কখনো বলবেন না আপনি সরকারি চাকরির জন্য ট্রাই করবেন।
যখন বলবেন সরকারি চাকরি করবেন না তখন স্বাভাবিক ভাবেই পরের প্রশ্ন করবে কেন যাবেন না? এর অনেক উত্তর আছে। সব সময় পজিটিভ উত্তর দিবেন। নেগেটিভ উত্তর ভাইভাতে ভালো চোখে দেখে না। আপনি বলতে পারেন, আপনার কর্পোরেট চাকরির প্রতি ফ্যাসিনেশন আছে। সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রকৃয়া বেশ দীর্ঘ আর জটিল। স্যালারি কম। ইত্যাদি। ভুলেও বলবেন না নিয়োগে দূর্নীতি হয়।
৫. আপনি মাইক্রোসফট অফিসের কাজ খুব ভালো পারেন।
এই দক্ষতা সবার জন্য মাস্ট। আপনাকে দক্ষ হতেই হবে। সরকারি বলেন আর প্রাইভেট বলেন, ওয়য়ার্ড, এক্সেল আর পাওয়ার পয়েন্টের কাজে আপনাকে দক্ষ হতেই হবে। নয়তো টিকতেই পারবেন না। এর কোন বিকল্প নেই।
৬. আপনি দ্রুত শিখতে পারেন।
আমাদের দেশে ইউনিভার্সিটিতে যা শিখি তা কর্মক্ষেত্রে কাজে লাগে না। সেখানে নতুন করে শিখতে হয়। এটা নিয়োগকর্তারা জানে। কিন্তু তাদেরও কাজের প্রেশার থাকে। আপনাকে যেকোনো একটা কাজ শেখাতে যদি বেশি সময় লাগে সেটা প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো কিছু না। প্রাইভেট সেক্টরে সময় আর টাকা দুইটাই খুবই মূল্যবান।
এমন যদি হয়, আপনার শিখতে সময় লাগে। হতেই পারে, সবাই দ্রুত শিখতে পারে না। সেক্ষেত্রে বলুন, আপনি একটু স্লো শিখলেও যেটা শিখেন খুব ভালোভাবে শিখেন। নিজের দুর্বল দিক গুলো পজিটিভলি উত্থাপন করটাও ভাইভাতে বেশ ভালো ভাবে নেয়।
৭. যেকোনো পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা আপনার আছে।
এক একটা প্রতিষ্ঠানে একেক রকম কর্ম পরিবেশ থাকে। সব শাখাতেই এসি লাগানো থাকবে না। অথবা সব সময় শহরেই আপনার পোস্টিং হবে না। আবার অনেক সময় চাকরির সার্কুলারেই লেখা থাকে, পোস্টিং বাংলাদেশের যেকোন স্থানে হতে পারে। কাজেই আপনি যদি বলেন, যেকোনো পরিবেশে আপনি খাপ খাইয়ে নিতে পারেন সেটা পজিটিভ ইম্প্রেশন তৈরি করবে।
৮. আপনার মধ্যে লিডারশীপ ক্যাপাবিলিটি আছে।

আপনাকে আমরা কেন নেব- এই প্রশ্নের উত্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হল লিডারশীপ ক্যাপাবিলিটি। লিডারশীপ ক্যাপাবিলিটি এমন একটা গুণ যেটা জীবনের সব ক্ষেত্রেই আপনাকে এগিয়ে রাখবে। এই কথা বলার আগে ঠিক করে রাখবেন, কিভাবে বোঝা যাবে যে আপনার মধ্যে লিডারশীপ আছে। হতে পারে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে গেলে সব কিছু আপনি ম্যানেজ করেন। হতে পারে আপনার বাবার দোকানের কর্মচারীদের দেখভাল আপনি করেন। হতে পারে ক্যাম্পাসে আপনি কোন একটা ক্লাব/ সংগঠনের সভাপতি/সাধারন সম্পাদক ছিলেন বা স্যাররা বিভিন্ন সেমিনার বা ইভেন্ট আয়োজনের দায়িত্ব আপনাকে দিত। এসব অভিজ্ঞতা আপনাকে ভাইভাতে এগিয়ে রাখবে। নিয়োগকর্তারা বুঝবেন তারা এমন একজন কে নিয়োগ দিতে যাচ্ছেন যে ম্যানেজ করতে পারেন। প্রাইভেট সেক্টরে ম্যানেজ করতে পারার মত বড় গুণ আর নাই।
আপনি যদি অভিজ্ঞ ক্যান্ডিডেট হন
আপনার অভিজ্ঞতার বিষয়ে তাদের বিস্তারিত বলুন। আপনার পূর্বতন প্রতিষ্ঠানে আপনার কি কি অর্জন ছিল সেটা বলুন। যদি কোন নতুন আইডিয়া আপনি দিয়ে থাকেন তাহলে সেটা জোর দিয়ে বলুন। নতুন কি আপনি জানেন যেটা নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানে নেই সেটার উপর জোর দিন।
আপনি আগের প্রতিষ্ঠানে যে কাজ করতেন সেটার সম্পর্কে খুব ভালো ধারনা রাখবেন। যেন কোন প্রশ্ন করে আপনাকে আটকতে না পারে।
আপনি যদি আপনার প্রফেশনের সাথে সম্পর্কিত কোন সফটওয়্যার ব্যবহারে দক্ষ হন সেটাও বলুন। এমনও হতে পারে পূর্বের কোম্পানিতে যে সফটওয়্যার ব্যবহার করতেন সেটা বর্তমান কোম্পানী চালু করার চিন্তাভাবনা করছে। সেক্ষেত্রে আপনি ভাইভাতে ক্লিয়ার এডভান্টেজ পাবেন।
আপনাকে আমরা কেন নেব- এটা মূলত নিজেকে উপস্থাপন করা বা বিক্রি করার প্রশ্ন। বাজারে যেমন বিক্রেতা তার পণ্য সম্পর্কে বিভিন্ন ভালো ভালো কথা বলে ক্রেতা কে আকৃষ্ট করে এই প্রশ্নের উত্তরেও আপনাকে সেভাবে উত্তর দিতে হবে। তাহলেই আপনি ভাইভা তে সফল হতে পারবেন।