বাংলাদেশে দিন দিন ককাটিয়েলের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। কারন হিসেবে বলা যায়, এদের সহজে পোষ মানানো যায়। তুলনামূলক ভাবে সহজে যত্ন নেয়া যায়, জায়গা লাগে কম, কথা বলতে না পারলেও শিস দিতে পারে দুর্দান্ত। এছাড়া টিয়াপাখির তুলনায় এরা সহজলভ্য। এই আর্টিকেলে আমরা কোকাটিয়েলের মিউটেশন, যত্ন, খাবার, রোগ, দাম ইত্যাদি অর্থাৎ ককাটেল পাখি পালন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।

কোকাটেলের মিউটেশন
কোকাটেলের ১৪ টা কালার মিউটেশন আছে। তবে আমাদের দেশে গ্রে, লুটিনো (সবচেয়ে জনপ্রিয়), লুটিনো পার্ল, সিনামন পার্ল, পার্ল, এলবিনো (হোয়াইট ফেস ইনো), হোয়াইট ফেস, পাইড, পার্ল পাইড, ক্রিম ফেস, হেভি পাইড (অন্যতম দামি মিউটেশন), সিনামন পার্ল পাইড, ক্লিয়ার পাইড, ভি পাইড (সবচেয়ে দামি) ইত্যাদি।
এদের মধ্যে গ্রে ফেস হল অরিজিনাল বন্য মিউটেশন। বাকি গুলো এই গ্রে মিউটেশন থেকেই উৎপন্ন হয়েছে। বাকি সব মিউটেশন এর চেয়ে গ্রে ফেস মিউটেশনের পাখি গুলো শক্তপোক্ত হয়। রোগ বালাই কম হয়।

কোকাটেলের খাবার
প্রধান খাবার সিডমিক্স। সীডমিক্সে নিচের আইটেম গুলো রাখা উচিৎ
চিনা ৪ কেজি
সূর্যমুখীর বীজ ২ কেজি
লাল মিলেট ৫০০ গ্রাম
সাদা মিলেট ৫০০ গ্রাম
হলুদ মিলেট ৫০০ গ্রাম
পোলাও ধান ৫০০ গ্রাম
ক্যানারি ১ কেজি
যব ১ কেজি
মোট ১০ কেজি। উপরের অনুপাত একেক জনের একেক রকম হয়। তবে বেসিক মিক্স একই থাকে। আপনি চাইলে কুসুম ফুলের বীজ দিতে পারেন, কিয়া সিড দিতে পারেন। এটা আপনার উপর নির্ভর করবে।
আপনি চাইলে মিষ্টি কুমড়ার বীজ দিতে পারেন। উপরের খাবার গুলো ভালো করে ধুয়ে কড়া রোদে শুকিয়ে নিবেন। যদি সামর্থ্য থাকে তাহলে ককাটেলের জন্য ইম্পোর্ট করা খাবার দিলে সব চেয়ে ভালো হয়।

সপ্তাহে তিন দিন শাক সবজি দিন। অবশ্যই ভালো করে ধুয়ে দিবেন। কাচা শাক সবজি দুই তিন ঘন্টার বেশি রাখবেন না।
প্রতিদিন পরিষ্কার খাবার পানি দিবেন। পানি ভালো হলে অনেক রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকবে আপনার পাখি।
প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে তিন থেকে চার দিন পাখি কে ক্যালপ্লেক্স আর ভিটামিন এ দিন (রেনাসল এডি৩ই দিতে পারেন)। এক পট পানিতে সাত ফোটা ক্যালপ্লেক্স আর তিন ফোটা ভিটামিন এ মিশিয়ে দিবেন। ওষুধ মিশ্রিত পানি ছয় ঘন্টার বেশি রাখবেন না। পানি চেঞ্জ করে ফ্রেশ পানি দিবেন।
কোনো খাচার পাখি মানুষের খাবার খেতে পারেনা। লবণ এবং চিনি পাখির জন্য বিষাক্ত। কাজেই পাখিকে ভাত, সেভেন আপ এসব খাওয়াবেন না।
প্রতিদিন পাখি কে ছোলা বা গম ভেজা খেতে দিবেন। গম বা ছোলা আগের রাতে ভিজিয়ে পরের দিন সকালে ভালো করে ধুয়ে খেতে দিন। এতে আপনার পাখির পুষ্টির ঘাটতি হবে না।
এছাড়া যদি আপনার পাখি ব্রিডিং এ থাকে তাহলে প্রতিদিন অবশ্যই গম বা ছোলা ভেজা দিবেন। এতে বেবির পুষ্টি ভালো হবে।
সফট ফুড অর্থাৎ গম বা ছোলা ভেজা, শাক সবজি, ফল, মরিচ সকালের দিকে দিবেন। দুই-তিন ঘন্টা পরে সিড মিক্স দিবেন। রাতে খাচা থেকে সিডমিক্সের বাটি, পানির পট সরিয়ে রাখবেন।
কোকাটেলের খাচার মাপ
কোকাটেলের জন্য নূন্যতম ২৪×২৪ ইঞ্চি খাচা লাগবে। যদি ব্রিড করাতে চান তাহলে ৩৬×২৪×২৪ ইঞ্চি খাচা দিতে হবে। ২৪×২৪ খাচাতেও ব্রিড করানো যায়। তবে ৩৬×২৪×২৪ ইঞ্চি তে ভালো রেজাল্ট পাবেন। ককাটেল ব্রিডিং বক্সের মাপ ১০x১২x১০ ইঞ্চি।
খাচায় পাশাপাশি দুইটা পার্চ বা ডাল দিবেন যাতে পাখি এক পার্চ থেকে অন্য পার্চে উড়ে যেতে পারে। নিমের ডাল হলে সবচেয়ে ভালো হয়। তবে চারকোনা করে কাটা কাঠের পার্চ হলেও হবে।
প্রতি সপ্তাহে অন্তত দুইবার খাচা পরিষ্কার করতে হবে। পরিষ্কার খাচা অনেক রোগ বালাই থেকে পাখিদের রক্ষা করে।
কোকাটেলের রোগ বালাই
কোকাটেল ঠান্ডা সহ্য করতে পারে না। কাজেই পাখির খাচা এমন স্থানে রাখবেন যেখানে ফ্যানের বাতাস বা প্রাকৃতিক বাতাস সরাসরি না লাগে।
ককাটেলের সবুজ পায়খানা বা ডায়রিয়া অন্যতম একটা সমস্যা। পরিষ্কার পানি এবং খাবার ব্যবহার করলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশে যেহেতু অনেক গরম পরে কাজেই পাখির হিট স্ট্রোক করার সম্ভাবনা থাকে। গরমের দিনে খাচায় গোছল করার জন্য পানি দিন।
ককাটেল পাখি পালন পদ্ধতি-মাসিক ওষুধের কোর্স
(নিচের অংশটি বাংলাদেশ এভিয়ান কমুনিটি গ্রুপ থেকে নেয়া। এটি বাংলাদেশের সব বড় বড় ব্রিডারদের রেজিস্টার্ড কমুনিটি। এটি একটি হোমিওপ্যাথি কোর্স।)
প্রতি মাসে পর্যায়ক্রমে দুই দিন নাক্স ২০০,দুই দিন পালসেটিলা ২০০, দুই দিন সাল্ফার ২০০ কোর্স করালে অনেক রোগের বিরুদ্ধে পাখির ইমিউনিটি সিস্টেম ডেভলপ করবে । একটা শেষ করে পরবর্তী ড্রাগে যেতে হবে, তখন পূর্ববতী ড্রাগ বন্ধ থাকবে।ডোজ ২০০ মিলি পানিতে ৪/৫ ফোটা।
সিজনাল কোর্স শীতকালীন
ক্যাম্ফার ২০০- ৩ দিন। এক সপ্তাহ পরে বেলেডোনা ২০০- ৩ দিন সব পাখিদের।
গরম ও বর্ষাকালীন কোর্স
একোনাইট ২০০- ২ দিন ডালকামারা ২০০- ৩ দিন, গ্লোনইন ২০০-৩ দিন সব পাখিদের। একটা শেষ করে পরবর্তী ড্রাগে যেতে হবে, তখন পূর্ববতী ড্রাগ বন্ধ থাকবে। কোন গ্যাপ দিতে হবেনা । ডোজ ২০০ মিলি পানিতে ৪/৫ ফোটা।
কৃমি প্রতিরোধে কোর্স
সিনা ২০০, ৩ দিন। বেস্ট হবে পাখি ব্রীডে দেওয়ার আগে দিয়ে পৃথক থাকাকালীন । ডোজ ২০০ মিলি পানিতে ৪/৫ ফোটা।
হোমিও লিভার টনিক
এই ক্ষেত্রে তিন টি হোমিও মাদার টিংচার (Q) যথাক্রমে কালমেঘ, আমলকি , চেলিডোনিয়াম তিনটি ই সমান (আফ আউন্স বা ১ আউন্স,কোনটি বেশি বা কম হতে পারবে না ) পরিমানে কাচের খালি বোটলে মিশিয়ে ভালো করে মিশিয়ে এই লিভার টনিক কম্বিনেশন তৈরি করতে হবে। প্রতিবার ব্যবহারের পূর্বে টনিকের বোটল ভালো ভাবে ঝাঁকিয়ে নিবেন।ডোজ ২০০ মিলি পানিতে ৫ ফোটা।
কোকাটেলের কেংকার রোগ
ক্যাংকার পোষা পাখির অন্যতম ভয়ংকর রোগ। এটি মা বাবা থেকে বেবির কাছে যায়। মা বাবা বেবিকে খাওয়ানো বন্ধ করে দেয়। ফলে বেবি মারা যায়। আপনার এভিয়ারিতে যদি একটিও ক্যাংকার আক্রান্ত পাখি থাকে তাহলে সেটি সব পাখিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
মার্কসল ২০০- ব্রীডিং কোর্স শেষ করে ২ দিন। মার্কসল ২০০- বেবী ফুটার ২ দিন পর ৩ দিন। এসিড নাইট্রিকাম ২০০ পরবর্তী ৩ দিন। কোন গ্যাপ দিতে হবেনা ডোজ ১০০ মিলি পানিতে ৪/৫ ফোটা।
ককাটেলের ব্রিডিং কোর্স
নাক্সভোম ২০০- ২ দিন, চায়না ২০০- ৩ দিন, ক্যালকেরিয়া ফস ২০০- ৪-৫ দিন, সেলেনিয়াম ২০০-৩ দিন, জিঙ্কাম-মেট ২০০ শেষ ৩ দিন। একটা শেষ করে পরবর্তী ড্রাগে যেতে হবে, তখন পূর্ববতী ড্রাগ বন্ধ থাকবে। কোন গ্যাপ দিতে হবেনা । বেস্ট হবে পাখি ব্রীডে দিয়ে। ডোজ ২০০ মিলি পানিতে ৪/৫ ফোটা।
সব ধরনের পাখি ও কবুতরের ক্ষেত্রে অবশ্যই অবশ্যই হোমিওপ্যাথি লিকুইড দিতে হবে কোনও পরিস্থিতেই বড়ি বা পাউডার ব্যবহার করা যাবে নাহ। রাত ৯ টায় পানি সরিয়ে দিয়ে পরের দিন সকালে ঔষধ মেশানো পানি দিতে হবে । সারাদিন ওই পানি থাকবে।রাতে পানি ফেলে দিতে হবে।
ককাটেল পাখি পোষ মানাবেন যেভাবে
পোষ মানানোর প্রধান শর্ত হল পাখিকে প্রচুর সময় দিতে হবে। পোষ মানানোর জন্য একেবারে ছোট বেবি না নিয়ে অল্প অল্প একা খেতে পারে এমন বেবি নিন। একেবারে ছোট বেবি না নিলে পোষ মানানো যাবে না এটা একেবারে ভুল কথা। তাছাড়া ছোট বেবি নিলে অনেক সময় বাচানোই কঠিন হয়ে যায়।
শুধু মাত্র পোষার জন্য খাচাতে খেলনা দিতে হবে। খেলনা বলতে বিভিন্ন নরম কাঠের টুকরো, টয়লেট টিস্যুর কাগজের রোল দিতে পারেন। প্রতিদিন পাখিকে খাচার বাইরে এনে তার সাথে খেলবেন।
আপনি যা শেখাবেন সে তাই শিখবে। তবে কোকাটেল ভালো শিস দিতে পারে। নাম রাখবেন দুই অক্ষরের। এতে সে সহজে শিস দিয়ে তা বলতে পারবে।
ককাটেল পাখির দাম
ককাটেল পাখি পালন পদ্ধতি সম্পর্কে তো জানলাম। এবার আসুন দেখি কোকাটেল পাখির দাম কেমন। পাখির দাম সব সময় উঠা নামা করে। তাই ১০০% নিশ্চয়তা দিয়ে বলা সম্ভব না যে কোন পাখির দাম কত। একটা রেঞ্জ এখানে বলার চেষ্টা করব।
তাছাড়া পাখির কোয়ালিটির উপরেও দাম নির্ভর করে। যে ব্রিডার পাখিকে ভালো খাবার খাইয়েছে, যত্ন নিয়েছে স্বভাবিক ভাবেই সেই ব্রিডারের পাখির দাম বেশি হবে।
চলুন দেখি কেমন দাম হতে পারে-
গ্রে ককাটেল- প্রতিটা বেবি ১৫০০/- থেকে ২০০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ৫০০০-৬০০০ টাকা লাগবে।
লুটিনো ককাটেল- প্রতিটা বেবি ২০০০/- থেকে ২৫০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ৮০০০-১০০০০ টাকা লাগবে।
সিনামন-প্রতিটা বেবি ২০০০/- থেকে ২৫০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ৮০০০-১০০০০ টাকা লাগবে।
লুটিনো পার্ল – প্রতিটা বেবি ২৫০০/- থেকে ৩০০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ৯০০০-১০০০০ টাকা লাগবে।
এলবিনো- প্রতিটা বেবি ৩০০০/- থেকে ৩৫০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ১২০০০-১৫০০০ টাকা লাগবে।
পাইড-প্রতিটা বেবি ২৫০০/- থেকে ৩০০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ৯০০০-১০০০০ টাকা লাগবে।
হেভি পাইড-প্রতিটা বেবি ৫০০০/- থেকে ৬০০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ১৫০০০-২০০০০ টাকা লাগবে।
ভি পাইড-প্রতিটা বেবি ৮০০০/- থেকে ১০০০০/-। ভালো একটা পেয়ারের দাম ২৫০০০-৩০০০০ টাকা লাগবে। ভি পাইডের কোয়ালিটির উপর নির্ভর করে এর দাম ৫০০০০ হাজারও হতে পারে।
কোয়ালিটিফুল পাখি চাইলে আপনাকে বেশি দাম দিতেই হবে। এতে আপনার টাকা উঠেও আসবে। সস্তার বারো অবস্থা এটা সব সময় মাথায় রাখবেন।