টিয়া পাখির প্রতি মানুষের দুর্বলত প্রাচীন কাল থেকেই। দেখতে সুন্দর, কথা বলতে পারে, হাতে বসে খাবার খায় সাথে খুনসুটি করা ইত্যাদির জন্য এদের প্রতি মানুষের আর্কষন সেই প্রাচীন কাল থেকে। এছাড়া সঙ্গী হিসেবেও এরা চমৎকার। বিশেষ করে টিনেজ বয়সীদের বিপথে যাওয়া থেকে রক্ষা করতে টিয়া পাখি বেশ সাহায্য করে।
আপনি কি টিয়া পাখি পুষতে চান? বা টিয়া পাখির বাচ্চা ফুটাতে চান? চলুন আমরা টিয়া পাখি পালন সম্পর্কে আজ বিস্তারিত জানি।

টিয়া পাখির পালার পূর্বে যা জানতেই হবে
টিয়া পাখির বুদ্ধি একটা দুই বছরের বাচ্চার সমান। কাজেই বাসায় যখন একটা টিয়া থাকবে, ধরে নিন দুই বছরের বাচ্চা আপনার বাসায় সব সময় আছে। বাচ্চারা যেমন সব সময় সবার মনোযোগ আকর্ষন করার চেষ্টা করে, কিছু মনের মত না হলে চিৎকার করে আপনার টিয়াও তাই করবে। সে আপনার বা আপনার ফ্যামিলিত সদস্যের মনোযোগ আকর্ষন করতে চাইবে। মনোযোগ না পেলে চেচাবে। কাজেই এ ব্যাপারে আগেই সিদ্ধান্ত নিন।
টিয়া কিন্তু ময়নার মত না যে সারা দিন খাচায় থাকবে। মূলত এরা রাতে ঘুমানোর সময় খাচায় থাকতে চাইবে। দিনে অন্তত তিন থেকে চার ঘন্টা এদের খাচার বাইরে রাখতে হয়। নয়তো পোষ মানবে না। খাচার বাইরে থাকার সময় আপনি ফ্যান ছাড়তে পারবেন না। জানালা খুলতে পারবেন না। যতই পোষ মানানো হোক না কেন এরা সুযোগ পেলেই উড়ে বাইরে চলে যাবে। ছোট বাচ্চাদের মতই। বাইরে যে বিপদ আছে সেটা তারা বোঝে না। এদেরও অসুখ হয়। কাজেই ট্রিটমেন্ট সম্পর্কে আপনার ধারনা থাকতে হবে।
টিয়া পাখি কিন্তু মানুষের খাবার খেতে পারে না। মিষ্টি জাতীয় খাবার এদের জন্য বিষের মত। প্রতিদিন ফ্রেশ শাক সবজি, ফল সাথে সিড মিক্স দিতে হবে। অর্থাৎ এদের পালন করার একটা খরচ আপনার হবে। সেটা মাথায় রাখবেন।
সবুজ টিয়া অর্থাৎ বন্য টিয়া পালা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। যদিও বেশির ভাগ মানুষ সেটা মানে না। কাজেই পালতে চাইলে আপনাকে খাচার পালা হয়ছে এমন টিয়ার বাচ্চা নিয়ে পালতে হবে।

কোন ধরনের টিয়া পালব
আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হত ইন্ডিয়ান রিংনেক টিয়া বা সবুজ টিয়া। সবুজ টিয়ার অনেক কালার আছে। আপনি চাইলে আপনার পছন্দ মত কালার নিতে পারেন। টিয়ার যে জাত গুলো খাচায় পালা হয়
১। ইন্ডিয়ান রিং নেক বা সবুজ টিয়া
২। এ্যালেক্সজান্ড্রিন টিয়া বা এলেক্স টিয়া বা চন্দনা টিয়া
৩। তোতা পাখি বা মদনা টিয়া
৪। প্লাম হেড বা ফুল মাথা টিয়া

এদের মধ্যে চন্দনা টিয়ার সাইজ সবচেয়ে বড়। চন্দনা টিয়ার কথা সবচেয়ে ক্লিয়ার হয়। এরা পোষও মানে ভালো। যদি সিরিয়াল করতে বলেন তাহলে- চন্দনা>সবুজ টিয়া বা রিং নেক>মদনা টিয়া বা তোতা পাখি। প্লাম হেট টিয়া কথা বলতে পারে না। তোতা পাখি পাওয়া একটু কঠিন।
রিংনেক হলুদ, সাদা, নীল, আকাশি নীল বিভিন্ন কালারের হয়। অন্যদিকে চন্দনা টিয়া হলুদ রঙ পাওয়া যায় তবে খুবই কম। সবুজটাই বেশি পাবেন। তোতা বা মদনা টিয়া এক কালারেরই হয়।
রিংনেক টিয়া বা সবুজ টিয়া এপ্রিল মে মাসে প্রাকৃতিক ভাবে বাচ্চা করে। এই সময়টা আপনি বন্য টিয়া পাখির বাচ্চা পাবেন প্রচুর। আমার পরামর্শ থাকবে এই বন্য বাচ্চা গুলো নেবেন না। এরা খাচায় বাচে না। শুধু শুধু আপনার টাকা নষ্ট হবে। একই কথা চন্দনা টিয়ার ক্ষেত্রেও খাটে জানুয়ারি মাসের দিকে চন্দনা বাচ্চা ফুটায়। ওই সময় এই বন্য বাচ্চা গুলো কেনা থেকে বিরত থাকুন।

খাচায় প্রায় সারা বছরই এই টিয়ার বাচ্চা ফোটে। আশে পাশে বা ফেসবুক গ্রুপে খোজ নিন কার কাছে খাচায় ফোটানো বাচ্চা আছে। সেগুলো নিন। ঐ বাচ্চা গুলো খাচায় বড় হয়ে অভ্যস্ত। এরা সহজে অসুস্থ্য হবে না।
কত বয়সী টিয়া পাখির বাচ্চা নেব
অনেকে মনে করে একেবারে ছোট বাচ্চা না নিলে পোষ মানবে না। এটা ভুল ধারনা। একেবারে ছোট বাচ্চা কে হ্যান্ড ফিড করাতে হয়। যেটা অভিজ্ঞতা না থাকলে করানো যায় না। অনেকেই হ্যান্ড ফিড করাতে গিয়ে বাচ্চা মেরে ফেলে। সেক্ষেত্রে বলব নিজে নিজে খেতে শিখেছে এমন বাচ্চা নিন। যদি ছোট বাচ্চা নিতেই চান তাহলে আগে ইউটিউব দেখে আগে হ্যান্ড ফিড করানো দেখে নিন। দরকার বা সুবিধা থাকলে যার কাছ থেকে বাচ্চা নিবেন তার কাছে গিয়ে শিখে আসুন।
একেবারে ছোট বাচ্চা কে খাচার মধ্যে রাখা যায় না। এদের গরম বক্সে রাখতে হয়। পরিপূর্ণ পালক না গজানো পর্যন্ত উষ্ণ না রাখলে বাচ্চার ঠান্ডা লেগে যাবে। কাজেই ছোট বাচ্চা নিলে উষ্ণ রাখার ব্যবস্থা আগে থেকেই করে রাখু।
টিয়া পাখির খাচার মাপ
সিংগেল পূর্ণ বয়স্ক টিয়া পাখির জন্য নূন্যতম দুই ফিট বাই তিন ফিট খাচা লাগে। যদি ব্রিডীং করাতে চান তাহলে নূন্যতম তিন ফিট বাই পাঁচ ফিট খাচা লাগবে। টিয়ার খাচার তার মোটা হতে হবে। নয়তো কেটে বেড়িয়ে যাবে।
পোষার জন্য ভালো খাচা পাওয়া যায়। খাচায় অনেক খেলনা দিতে হবে। নয়তো এরা সহজেই বিরক্ত হয়ে চিৎকার করে। অনেক সময় নিজের পালক নিজেই তুলে ফেলে। খেলনা বলতে বিভিন্ন কাঠের টুকরা দিয়ে তৈরি খেলনা বোঝাচ্ছি। এগুলো কে এরা ঠোট দিয়ে কেটে টুকরা করবে। এটাই ওদের খেলা।
খেলনা হিসেবে প্লাস্টিক দেয়া যাবে না।
টিয়া পাখির খাবার
বাচ্চা পাখির জন্য সব চেয়ে ভালো খাবার হল Nutribird A19 আর Nutribird A21। বাসায় বানানো খাবার না দেয়াই ভালো। বাচ্চা পাখি বাসায় নিয়ে আসার আগেই এই দুইটা খাবারের যেকোন একটা কিনে রাখবেন।
পূর্ণ বয়স্ক টিয়ার খাবারে আছে সিড মিক্স, প্রতিদিন একটা কাচা ফল, শাক সবজি। প্রতিদিন কাচা মরিচ খেতে দিন। টিয়া পাখির জন্য আলাদা সিড মিক্স কিনতে পাওয়া যায়। ফল শাক সবজি ভালো করে ধুয়ে বীজ ছাড়িয়ে দিবেন। আঙুর না দেয়াই ভালো একই কথা খেজুরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তবে আমাদের দেশিয় খেজুর দিতে পারবেন। অর্থাৎ মিষ্টি জাতীয় খাবার, লবণ, সেভেন আপ এগুলো দিবেন না। প্রতিদিন পরিষ্কার খাবার পানি দিন। আপনি যে পানি খান তাদেরও সেটিই খেতে দিন।
টিয়া পাখির মেল ফিমেল কীভাবে চিনব
বাচ্চা টিয়ার মেল ফিমেল দেখে বলা সম্ভব না। অনেকেই বলতে পারে। কিন্তু সেটা ১০০% সঠিক না। ডিএনএ টেস্ট করে বলা সম্ভব। পূর্ণ বয়স্ক চন্দনা আর রিং নেক টিয়ার মেল পাখির গলার চারদিকে রিং থাকে। ফিমেল পাখির থাকে না। তোতা পাখির ক্ষেত্রে মেল পাখির ঠোট লাল হয় অন্য দিকে ফিমেল পাখির ঠোট কালো হয়।

টিয়া পাখির দাম
এখানে বাচ্চা পাখির দাম দিয়েছি। পূর্ণ বয়স্ক পাখির দাম বাচ্চা পাখির তুলনায় বেশি হয়।
চন্দনা বা এলেক্স টিয়া- ৫০০০ – ৮০০০ টাকা
রিংনেক টিয়া- সবুজটা ২৫০০ – ৪০০০ টাকা। অফ সিজন হলে ৫০০০টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
হলুদ বা লুটিনো রিংনেক- ১০০০০ – ১২০০০ টাকা
বাটারকাপ (হালকা হলুদ বা ঘিয়ের মত কালার)- ৮০০০ – ১২০০০ টাকা
ভায়োলেট (ডাবল ফ্যাক্টর ভায়োলেট) বা বেগুনী – ১২০০০ – ১৫০০০ টাকা
ব্লু বা নীল – ১২০০০ – ১৫০০০ টাকা
এলবিনো বা সাদা- ১৫০০০ – ২০০০০ টাকা
মদনা টিয়া – ৪০০০ – ৫০০০ টাকা
পূর্ণ বয়স্ক পাখি নেয়ার আগে খেয়াল করে নিবেন ওগুলো হোম ব্রীড নাকি বন্য। বন্য পাখির খাচার সামনে গেলে ভয় পাবে। উড়াউড়ি করবে। বন্য টিয়া খাচায় ডিম বাচ্চা করে না।
টিয়ার বাচ্চা পোষ মানাব কীভাবে
টিয়া বা যেকোনো পাখি পোষ মানানোর একটাই উপায় আছে সেটা হল পাখি কে প্রচুর সময় দিতে হবে। প্রতিদিন তাকে সময় দিন। ধীরে ধীরে সে আপনার পোষ মেনে যাবে। এটা এক দিন বা দুই দিনের ব্যাপার না। কয়েক মাস পর্যন্ত লাগে। ধৈর্য ধরতে হবে।
এমন না যে একবার পোষ মেনে গেছে বলে পরে আর সময় দিলেন না। পোষ মানানোর পরেও আপনাকে নিয়মিত সময় দিতে হবে। এটা যত দিন আপনার কাছে থাকবে তত দিন তাকে আপনার সঙ্গী হিসেবে বিবেচনা করবেন।
পাখি কে ভয় দেখাবেন না। অনেকেই খাচা ধরে ঝাকাঝাকি করে। জোরে শব্দ করে ভয় দেখায়- এটা কখনোই করবেন না।
টিয়া পাখি কে কথা বলা শেখাবে কীভাবে
দুই অক্ষরের ছোট একটা নাম দিন। ঐ নাম ধরে ডাকুন সবসময়। পাখির সাথে প্রচুর কথা বলুন। দ্রুত কথা না বলে ধীরে ধীরে কথা বলুন। আস্তে আস্তে কথা বলা শিখে যাবে। ক্লিয়ার কথা শুনতে চাইলে চন্দনা টিয়া নিন।
পরিশেষে বলব টিয়া পাখি কিন্তু হাস মুরগী না। এদের বাসায় আনা মানে একটা অতিরিক্ত দায়িত্ব নেয়া। আপনি যদি এই দায়িত্ব না পালন করতে পারেন তাহলে পাখি না নেয়াই ভালো। এছাড়া এরা ৫০ বছর পর্যন্ত বাচে। কাজেই এটা একটা লম্বা কমিটমেন্টের বিষয়।
এরা কিন্তু চমৎকার সঙ্গী। এদের সাথে সময় কাটাতে গেলে দেখবেন আপনার সময় কোন দিক দিয়ে চলে যাচ্ছে বুঝতেই পারবেন না। টিভি বা ফেসবুকে সময় নষ্ট করার চেয়ে এদের সাথে সময় কাটালে মানসিক দিক দিয়ে অনেক ভালো থাকবেন। আমার ডিপ্রেশন কাটানোর জন্য আমি টিয়া নিয়েছি। অফিসে অনেক কাজের চাপ থাকলে বাসায় এসে আমার টুকুর সাথে আধা ঘন্টা থাকলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যায়। তাছাড়া আমার মেয়েও এখন আর আগের মত টিভির সামনে বসে না। সময় পেলেই সে টুকুর সাথে বসে কথা বলে, খেলে।
হ্যাপি বার্ড কিপিং!