আপনার পড়াশোনায় মনোযোগী হওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছে? কার হয় না বলুন? এটি কম বেশি সবারই হয়, এমনকি ক্লাসের সেরা ছাত্রদের ক্ষেত্রেও ঘটে। আপনার পড়াশোনায় মনোনিবেশ করার জন্য আপনাকে কেবল হয়তো পড়াশোনার স্টাইলে একটু চেঞ্জ আনতে হবে, বাইরের ঝামেলা মুক্ত একটি নিরিবিলি জায়গায় পড়তে হবে।
হয়তো একটি নতুন টেকনিক চেষ্টা করতে হবে, বা নতুন কোন পরিকল্পনা অনুযায়ী পড়বেন যাতে আপনার মাথায় চাপ না লাগে। আপনার দরকার এমন একটা টেকনিক যেটা আপনার সাথে খাপ খায়। ভালো একটি টেকনিক, সঠিক পরিবেশ আর শান্ত একটি মন, ব্যস আপনার জন্য মনোযোগ দেয়া কোন সমস্যাই হবে না।

মনোযোগী হতে চাইলে মনকে শান্ত এবং ফোকাসড রাখুন
একটি সময়সূচি/রুটিন তৈরি করুন। ধরুন আপনার বেশ অনেক খানি পড়তে হবে, সেক্ষেত্রে সব পড়া রাতের জন্য রাখবেন না। দিনের জন্যও প্ল্যান করুন।
সময়সূচি বা টাইম টেবিল করবেন এমন ভাবে যেন একটানা ৩০-৬০ মিনিট এর বেশি পড়তে না হয়। ৩০-৬০ মিনিট পরে ৫-১০ মিনিট বিরতি দিয়ে আবার ৩০-৬০ মিনিটের জন্য পড়ুন।
পড়াকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করার চেষ্টা করুন। একটানা পড়তে থাকলে আমাদের মস্তিষ্ক ক্লান্ত হয়ে যায়। এই ক্লান্তি দূর করার জন্য ৫-১০ মিনিটের ব্রেক নিন। এর ফলে ৩০-৬০ মিনিট ধরে যা পড়েছেন সেগুলো আপনার মস্তিষ্ককে গুছিয়ে নেয়ার সুযোগ পায়। ফলে আপনি সহজে মনে রাখতে পারবেন।
একই বিষয় টানা কয়েক ঘন্টা পড়বেন না। এতে আপনার ঐ বিষয়টি বিরক্তিকর লাগবে। ধরুন সকাল ৭-৮ পর্যন্ত গনিত করেছেন। তাহলে ৮ঃ১০ থেকে ৯ টা পর্যন্ত বিজ্ঞান পড়ুন। নতুন বিষয় পড়লে আমাদের মনোযোগ বাড়ে, মাথা জ্যাম হয় না। এতে আপনি মোটিভেটেড থাকবেন।
পড়ার সময় শুধুমাত্র পড়া নিয়েই ভাববেন। অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করার জন্য বা অন্যান্য বিষয়ে চিন্তা করার জন্য সময় আলাদা করুন।
পড়তে বসলে আর প্রার্থনার সময় দুনিয়ার চিন্তা আমাদের মাথায় ঢুকে। এটা থেকে বিরত থাকতে হবে। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যে আমাদের চিন্তার উপর আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, এটা কিন্তু ভুল ধারণা। নিজেকে বলুন যে পড়া শেষ হয়ে গেলে অমুক সমস্যা বা সেই মেয়ে বা ছেলেটির কথা ভাববেন। কোনভাবে যদি এটা একবার শুরু করতে পারেন তাহলে পরবর্তীতে আর তেমন সমস্যা হয় না।
পড়তে পড়তে যদি অন্য চিন্তা মাথায় ঢুকে তাহলে সাথে সাথে পড়া বন্ধ করুন। চেয়ার থেকে উঠে একটু হাটুন বা মাথা ঝাকিয়ে নিন। আপনার চিন্তা আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ধরেন পড়তে পড়তে আপনার বিশ্বকাপের কথা মনে হয়েছে, সাথে সাথে সেটা একটা খাতায় লিখে রাখুন ‘বিশ্বকাপ’। যখন বিরতি নিবেন তখন বিশ্বকাপ নিয়ে কি চিন্তা মাথায় আসছিল সেটা ভাবার চেস্টা করবেন। দেখবেন ধীরে ধীরে আর এসব চিন্তা আর আসবে না।
পড়তে বসতে মন চায় নাঃ পড়ার স্টাইল পরিবর্তন করুন।

আমরা বেশিরভাগই যেটা করি, যে কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর টানা মুখস্থ করি। ধরা যাক আপনি মুখস্থ করেছেন, বেশ ভালোই করেছেন। বই বন্ধ করে সেটা বলতেও পারছেন। এর মানে এই না যে ঐ প্রশ্নের উত্তরটা আপনার দুই দিন পরেও মনে থাকবে।
দীর্ঘ সময় ধরে মনে রাখার জন্য ঐ উত্তরের গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলো ছোট ছোট কাগজে লিখে রাখুন। যদি উত্তরে কোন সংখ্যা থাকে সেটাও লিখে রাখুন। বড় উত্তর গুলোর মাঝে যে ছোট ছোট উত্তর গুলো থাকে সেগুলোও লিখে রাখুন। এতে আপনার ব্রেইন সহজে মনে রাখতে পারবে।
ধরুন, আপনি বাংলার কোন একটি বড় প্রশ্নের উত্তর মুখস্থ করেছেন। এখন ভুলেও অন্য কোন বিষয়ের বড় প্রশ্ন মুখস্থ করতে যাবেন না অর্থাৎ পরপর দুইটা বড় প্রশ্ন মুখস্থ করবেন না। এতে আপনার মনোযোগ নষ্ট হবে। একটা বড় প্রশ্নের পরে অন্য বিষয়ের এমসিকিউ পড়তে পারেন, অংক করতে পারেন। এতে একঘেয়েমি লাগবে না।
পড়াশোনায় মনোযোগী হতে নিজেকে পুরস্কৃত করুন।
মনে করুন আজ আপনি বেশ ভালো ভাবে বিজ্ঞান পড়েছেন। তাহলে নিজেকে একটা পুরস্কার দিন। আপনার প্রিয় খাবার খেতে পারেন (তাই বলে বিরিয়ানি খেতে যাবেন না), একটা নাটক দেখতে পারেন। মোট কথা যেটা আপনার করতে ভালো লাগে সেটাই করবেন। নিজেকে বলবেন, আজ যদি এই চ্যাপ্টার শেষ করতে পারি তাহলে আধা ঘন্টা বেশি ফেসবুকিং করব। যদি কোন পরীক্ষায় ভালো করেন, তাহলে নিজের জন্য নতুন একটা ড্রেস কিনুন। দেখবেন ভালো লাগছে। পড়লেখায় উৎসাহ ফিরে আসছে।
এই উৎসাহ দেয়ার কাজে আপনার বাবা-মাকে ও ইনভল্ভ করতে পারেন। মাকে বলুন, ক্লাস টেস্টে ভালো করলে গরুর মাংস রান্না করতে হবে বা বাবাকে বলুন ফাইনাল পরীক্ষায় ভালো করলে কক্সবাজার বেড়াতে যেতে হবে। দেখবেন তারা খুব খুশি হয়েই আপনার সাহায্য এগিয়ে আসবে। মা-বাবার সাহায্য নিতে না পারলে বন্ধুর সাহায্য নিন, বড় ভাই বোনের সাহায্য নিন।
যে বিষয়টি আপনার পড়তে ভালো লাগে না সেটা পড়ার সময় একটু ভিন্ন টেকনিক ব্যবহার করবেন। যেমন- ছোট ছোট অংশে ভাগ করা, নিজেকে প্রশ্ন করা, এই বিষয়টি জানলে আপনি কি করতে পারবেন সেটা নিয়ে ভাবা। আমাদের একটা মিস কন্সেপ্ট আছে যে, আমরা যা পড়ি তা আমাদের বাস্তব জীবনে কোন কাজে লাগে না। আপনি যা পড়বেন তার ইতিহাস আর ব্যবহার একটু ইন্টারনেটে ঘাটলেই পাবেন। এই ইতিহাস ঘাটাঘাটি পড়ালেখা কে আরও আকর্ষনিয় করে তুলে। অপছন্দের বিষয় গুলো অবশ্যই জোরে জোরে পড়বেন।
যা কিছু পড়বেন তার ছোট ছোট নোট রাখবেন। কোন একটা প্যারার গুরুত্বপুর্ণ একটা শব্দ লিখে রাখবেন। এতে আপনার মুখস্থ করতে সুবিধা হবে। যে বিষয়ে আপনার বেসিক দূর্বল সে বিষয়ে বেসিক আগে ক্লিয়ার করে নিন। বেসিক ক্লিয়ার থাকলে যেকোনো বিষয় পড়তে ভালো লাগে।
সঠিকপড়ার স্থান নির্বাচন করুন
আপনার পড়ার রুমটি অবশ্যই শান্ত, কোলাহল মুক্ত হতে হবে। রুমে এমন কিছু রাখবেন না যাতে আপনার মনোযোগ নষ্ট হয়, যেমন- টিভি, পোষা প্রানী বা পাখি। হৈ চৈ থেকে মুক্ত, চিল্লাচিল্লি নাই এমন একটা রুম নিন পড়ার জন্য। ভালো একটা চেয়ার টেবিল নিন, টেবিলে যেন পর্যাপ্ত আলো থাকে। বিছানায় গড়াগড়ি দিতে দিতে পড়বেন না। টিভির শব্দ কানে আসে এমন জায়গায় পড়বেন না। মাঝেমাঝে চেয়ার না বসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ুন।
পড়তে বসার আগে আপনার প্রয়োজনীয় সব কিছু, কলম খাতা, বই, পেন্সিল, পানির বোতল হাতের কাছে রাখুন। যেন এসবের জন্য পড়া ফেলে উঠে যেতে না হয়। আপনার পড়ার টেবিলে কম্পিউটার বা ল্যাপটপ রাখবেন না। একটা গোছানো পড়ার টেবিল আপনার চিন্তাভাবনাকেও গোছাতে সাহায্য করবে। আর গোছানো মনের মানুষরা সব সময় সফল হয়।
টেবিলে হালকা কিছু খাবার যেমন বিস্কিট রাখতে পারেন। চা খাওয়ার অভ্যাস থাকলে ফ্লাস্কে চা রাখতে পারেন। অবশ্যই টেবিলে পানি রাখবেন।
আপনার পড়ার লক্ষ্য ঠিক করুন
আজ আপনি কি পড়তে চান, কতটা পড়তে চান। প্রতিদিনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আপনাকে কতটা এফোর্ট দিতে হবে? গত কাল কেন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেননি? এসব প্রশ্নের উত্তর আপনাকে সাহায্য করবে খুব। একদিনেই সব শেষ করে ফেলবেন এমন করবেন না। ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নিন। পড়ার সময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখুন বা এয়ারপ্লেন মুড অন রাখুন। বর্তমানে আপনাকে এক ঘন্টার জন্য কেউ ফোনে না পেলে এমন কিছু হবে না। খুব গুরুত্বপূর্ন কিছু হলে আপনার বা-মার ফোনে জানাতে পারবে। বিশেষ করে ফেসবুক ব্লক করে রাখুন। কিছু এপস আছে যেগুলো আপনাকে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ফেসবুক ব্যবহার করতে দিবে।
পড়ালেখায় মনোযোগী হতে চাইলে শরীরকে গুরুত্ব দিন
শরীরের কথা শুনুন। দিন বা রাতের যে সময়তা আপনার শক্তি বেশি থাকে সে সময়ে পড়তে বসুন। এতে আপনি ভালো ভাবে ফোকাস করতে পারবেন। কেউ ভোরে পড়তে পছন্দ করে, কেউ দিনে পড়তে পছন্দ করে। শরীরের উপর চাপ দিয়ে পড়তে যাবেন না। এতে খুব বেশি লাভ হয় না।
পর্যাপ্ত ঘুম সুস্থ্যতার অন্যতম শর্ত
পূর্ণবয়স্ক মানুষের কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুমের প্রয়োজন। দিনের ঘুমানোর অভ্যাস ত্যাগ করুন। আর আপনার ঘুম যেন নিরবিচ্ছিন্ন হয়। অতিরিক্ত ঘুম ত্যাগ করুন। চেষ্টা করুন সকালে উঠার। সকালে উঠতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই রাতে দ্রুত ঘুমাতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খান। প্রচুর পানি পান করুন। সুস্থ্য শরীর মানেই সুস্থ্য মন। অসুস্থ্য শরীর নিয়ে পড়াশোনায় মন দেয়া যায় না। বাইরের জাংক ফুড এড়িয়ে চলুন। চিনি কম খান।
মন থেকে নেগেটিভ চিন্তা গুলো বাদ দিন। আমি পারবনা এটা ভাববেন না। গণিত আমার কাছে কঠিন লাগে- এভাবে না ভেবে ভাবুন গনিত আপনি ধীরে বুঝেন। নেগেটিভ মাইন্ডেড বন্ধুবান্ধব এড়িয়ে চলুন।
সহজ এবং আপনার পড়তে ভালো লাগে এমন বিষয় গুলো আগে পড়বেন। কঠিন, বিরক্তিকর বিষয় গুলো আগেই পড়তে শুরু করলে আপনার এনার্জি শেষ হয়ে যাবে। আপনি আপনার দৈনিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারবেন না।
পজিটিভ চিন্তা, গোছানো মন, গোছানো পড়ার পরিবেশ আর কিছু টেকনিক এই হলো পড়ায় মনোযোগ বাড়ানোর সহজ সমাধান ।