কঠিন একটা প্রশ্ন! বিতর্কিতও। তাই পক্ষে বিপক্ষে বলব না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করব আজ। বাকিটা আপনারা বুঝে নিবেন।
তাহলে আগে আমার পরিচয় দিয়ে নেই। নাম বলছি না, আর্টিকেলের অথরে যে নাম দেখছেন নিশ্চয়ই আপনি সেটা আসল নাম হিসেবে বিশ্বাস করেননি? নামে কী বা আসে যায়! আমি বর্তমানে একটা সরকারি চাকরি করছি। ১০ম গ্রেডের চাকরি। বেতন সাকুল্যে ২৫ হাজার টাকা। আমার স্ত্রীও সরকারি চাকরি করে। সে অবশ্য বিসিএস ক্যাডার! সে কলেজের শিক্ষক।
আমরা দুইজনই একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি। হ্যা, আপনার সন্দেহ সঠিক আমরা পূর্ব পরিচিত এবং পছন্দের বিয়ে। যেহেতু বউ চাকরি করছে কাজেই ধরে নিন আমি বউয়ের চাকরি বা যে কোন পেশায় নিয়োজিত থাকা সমর্থন করি। কেন করি?

মেয়েরা কেন চাকরি করবে
আমার বাবা যখন মারা যান, তখন আমি ক্লাস এইটে পড়ি। আমার মা ক্লাস ফাইভ পাস। এই যোগ্যতা দিয়ে কোন চাকরি তার পক্ষে পাওয়া কঠিন ছিল। অথচ আম্মা যদি এস এস সি পাস থাকতেন তাহলে অনায়াসে আব্বার অফিসে একটা চাকরি পেতেন। আব্বা মারা যাওয়ার পরে কী কষ্ট যে তিনি করেছেন! কাজেই মেয়েদের পড়তে হবে। অবশ্যই গ্রাজুয়েট হতে হবে। নিজের ইনকাম সোর্স থাকতে হবে। কেননা যখন বিপদ আসে তখন মেয়েদের পড়া লেখা বা চাকরির বিরোধিতা করা মানুষ গুলো কে খুজে পাওয়া যায় না।
ভালো চাকরি কি
ভালো চাকরি মানে অবশ্যই ভালো বেতন। সাথে সম্মান, কাজের পরিবেশ ও সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা থাকতে হবে। সরকারি চাকরির চেয়ে বেসরকারিতে বেতন বেশি হলেও সরকারি চাকরির যে সম্মান আমাদের দেশে আছে এর জন্য ভালো চাকরি মানে সরকারি চাকরি বললেও ভুল হবে না (আমাদের সামাজিক প্রক্ষাপটে)।
ভালো চাকরি বলতে আমি ঐ চাকরিই বুঝি যার ভবিষ্যত ভালো। চলন সই বেতন এর সাথে ভালো একটা কাজের পরিবেশ থাকা চাই।
আমরা কোন চাকরি দিয়ে শুরু করেছিলাম
আমরা দুইজনই আমাদের অনার্সের বিষয় সম্পর্কিত চাকরিতে ঢুকেছিলাম। এর আগেও টুকটাক করেছি। কিন্তু বলার মত ছিল ঐ ফ্যাক্টরির চাকরিই। দুইজনি ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করেছিলাম। আমি পপুলার ফার্মাতে আমার স্ত্রী এস কে এফ ফার্মাসিউক্যালসে। পরবর্তীতে আমি স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করি।
আমাদের বেতন ভালো ছিল। কাজের পরিবেশও চমৎকার ছিল। ভালো ইনক্রিমেন্ট পেতাম। গন্ডোগোল লাগল যখন আমার শিফটিং ডিউটি শুরু হল। বি শিফটে আমার ট্রান্সপোর্ট বাস ছিল দুপুর ১২টায়। ফিরতে ফিরতে রাত ১২ টা। ততক্ষনে আমার বউ ঘুমে। আমি ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে ১ তা বেজে যেত। সকালে যখন উঠতাম ততক্ষণে বউ অফিসে চলে গেছে। আমরা বুঝে গেলাম আর যাই হোক ফ্যাক্টরি জব মেয়েদের জন্য নয়। শুরু হল আমাদের বিসিএস এর জন্য প্রস্তুতি।
প্রাইভেট চাকরি করে বাসায় এসে সংসার সামলে বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নেয়া আমার বউয়ের জন্য খুবই কঠিন ছিল। সেই অসাধ্য কাজটি সে করে ফেলল। ৩৩ বিসিএস এ সে এডুকেশন ক্যাডারে জয়েন করে ফেলল।
মেয়েদের জন্য কোন চাকরি ভালো-সরকারি?
তাহলে কি সরকারি চাকরি মেয়েদের জন্য ভালো? বেসরকারির চেয়ে অবশ্যই ভালো। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ১০ জন প্রাইভেট চাকরি করেন এমন মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা কি বলেন।
প্রাইভেট চাকরিতে যদি আপনাকে ২৫ হাজার টাকা মাসে বেতন দেয় তাহলে আপনার কাছে থেকে কমপক্ষে ২ লাখ টাকার কাজ তারা করিয়ে নেবে। দিন যত যাবে এই কাজের লোড বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশের কয়টি কোম্পানির শীর্ষস্থানীয় কর্তা ব্যাক্তি নারী বলতে পারবেন? কয়টা কোম্পানীতে নারী ম্যানেজার আছে? যদি ১০ জন পুরুষ ম্যানেজার থাকে তাহলে ১ জন নারী ম্যানেজার পাবেন কি না সন্দেহ আছে। অর্থাৎ একজন মেয়ের ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট একটা পর্যায়ে গিয়ে থেমে যায়।
কোন সরকারি চাকরি মেয়েদের জন্য ভালো
আমার স্ত্রীর ফার্স্ট চয়েস ছিল বিসিএস এডমিনিস্ট্রেশন। প্রথম বিসিএস এ সে শিক্ষা ক্যাডারে জয়েন করার পর পরবর্তী বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা যখন এল তখন দেখলাম তার পড়ালেখায় অতটা সিরিয়াসনেস নেই। এমনিতে সে সিরিয়াস ছাত্রী। ৩৪তম বিসিএসে ভাইভা কোন রকম দিলেও ৩৫তম বিসিএসে সে লিখিত পরীক্ষাই দিল না। তার একটাই কথা সে শিক্ষকতা ছাড়া অন্য ক্যাডারে যেতে চায় না। তার ভালো ক্যাডার লাগেবে না, তার শান্তি চাই।
কী রকম শান্তি? সপ্তাহে চার দিন সকাল নয়টায় কলেজে যায়। দুইটায় চলে আসে। ক্লাস না থাকলে না গেলেও চলে। অবশ্য সব কলেজেই যে এমন তা নয়। আর ছুটি তো আছেই। কোন মানসিক চাপ নেই, টার্গেট ফিলাপের প্রেশার নেই। বড় কলেজ গুলোতে অবশ্য পরিস্থিতি ভিন্ন। কিন্তু বড় কলেজে পোস্টিং নিচ্ছে কে?
তাই বলে সব টিচিং জবই কিন্তু এরকম না। সরকারি হাই স্কুল বা প্রাইমারি স্কুলে কিন্তু চাপ আছে বেশ। সারাদিন ক্লাস করাতে হয়।
তাহলে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারই মেয়েদের জন্য সবচেয়ে ভালো
আমাদের মেয়ে যখন হল তখন মূল সমস্যা ধরা পরল। সপ্তাহে চারদিন হোক বা একদিন হোক কলেজে তো যেতেই হবে। ওদিকে আমি তখনো স্কয়ারে চাকরি করি। তাহলে উপায়? কাজের লোক খুজতে লাগলাম। আমার মেয়েকে নিয়ে আমার স্ত্রী কলেজে যেত। বাচ্চাকে কোলে নিয়েই ক্লাস নিত। কাজের লোক পাওয়া কী যে কঠিন কাজ রে ভাই।
এমনও সিচুয়েশন গেছে যে আমার স্ত্রী ঠিক করে ফেলেছিল যে সে চাকরি ছেড়ে দিবে। ছেলে হওয়ার পরে আমার সরকারি চাকরি হয়। আমি স্কয়ারের প্রায় পৌনে এক লাখ টাকার চাকরি ছেড়ে সরকারি চাকরি তে জয়েন করি। এখনো স্ট্রাগল করছি বাচ্চাদের নিয়ে। কখনো আমি আমার অফিসে বাচ্চাদের নিয়ে যাই, বেশিরভাগ সময় আমার স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে যায়।
মেয়েদের চাকরির সব চেয়ে বড় অন্তরায় হচ্ছে সংসার আর বাচ্চা কাচ্চা। আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় বাবা যদি সন্তান কে টেক কেয়ার করে তাহলে সবাই কটু কথা শোনায়। অথচ কেউ এক বেলা বাচ্চাদের দেখে রাখে না।
যদি আপনার সন্তান কে আপনি বাসায় দেখভাল করার জন্য কাউকে রাখতে পারেন (বাবা, মা, শশুর শাশুড়ি বা অন্য কেউ) তাহলে যেকোন চাকরিই মেয়েদের জন্য ভালো। মেয়েরা সব চাকরিই করতে পারে এবং ভালো করে। কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুইজনই যদি টাইম কনজিউমিং চাকরিতে থাকে তাহলে স্বাভাবিক ভাবেই বাচ্চাদের সময় কম দিতে পারেন। সেক্ষেত্রে বাচ্চাদের নানান ধরনের মানসিক সমস্যা হয়। দুই জনের মধ্যে অন্তত একজনের চাকরিটা কম টাইম কনজিউমিং হওয়া ভালো।
যেহেতু সরকারি কলেজের চাকরিতে তেমন কাজের প্রেশার থাকে না। শিক্ষকদের অন্যরকম সম্মান ও আছে। কাজেই আমার মনে হয় কলেজের শিক্ষকতা মেয়েদের জন্য ভালো একটা চাকরি।
এরমানে এই না যে অন্য চাকরিতে মেয়েদের যাওয়া উচিত না। অবশ্যই যাবে। প্রচুর মেয়ে এডমিন ক্যাডারে, পুলিশ ক্যাডারে আছে। সেখানে তারা ভালো করছে। কিন্তু আপনি যদি আমাদের মত শান্তির জীবন চান তাহলে বলব কলেজের শিক্ষকতার উপরে ভালো চাকরি মেয়েদের আর নাই।