যারা খাচায় পাখি পালেন তাদের লাভবার্ডের প্রতি দূর্বলতা কাজ করে। বিভিন্ন আকর্ষনীয় রংয়ের জন্য এদের চাহিদা বেশি। তবে একেবারেই যারা নতুন।, তাদের দোকানদাররা অনেক সময় বাজরিগারকে লাভবার্ড বলে চালিয়ে দেয়। আমি নিজেই এর ভুক্তভূগী ছিলাম। প্রায় বছর খানেক পরে গিয়ে বুঝলাম বাজরিগারকে লাভবার্ড বলে কিনেছি।
নতুন যারা লাভবার্ড পালতে চান তাদের জন্য মূলত এই লেখা। পাখি পালন তো আর পড়ে পড়ে হয় না। এটা হাতে কলমে করতে হয়। কিন্তু তারপরও কিছুটা ধারণা নিয়ে শুরু করলে পরে হতাশ হতে হবে না। চলুন শুরু করা যাক-
লাভবার্ড আফ্রিকার পাখি। প্রকৃতিতে লাভবার্ড পাখির নয়টি প্রজাতি পাওয়া যায়। প্রাথমিক ভাবে লাভবার্ডকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
১. রিং লাভবার্ড।
২. নন রিং লাভবার্ড।
রিং লাভবার্ড এর চোখের চারদিকে সাদা রিং থাকে। নিচের ছবি খেয়াল করুন


নন রিং লাভবার্ড এর চোখের চারদিকে সাদা রিং থাকে না। নিচের ছবি খেয়াল করুন

বাংলাদেশে জনপ্রিয় লাভবার্ড প্রজাতি
ফিশার লাভবার্ড, মাস্কড লাভবার্ড, পিচ ফেস লাভবার্ড, মাদাগাস্কার লাভবার্ড। এদের আবার অনেক কালার মিউটেশন আছে।
লাভবার্ড পাখির খাচার মাপ
নূন্যতম মাপ হল: 18*18*24 ইঞ্চি, এক্ষেত্রে ব্রিডিং বক্স খাচার বাইরে দিতে হবে। ভালো রেজাল্ট পাওয়া যায় 24*24*24 ইঞ্চি খাচায়। যত বড় খাচা দিবেন তত ভালো।
লাভবার্ড পাখির রোগ বালাই
লাভবার্ড বেশ শক্ত পাখি। সহজে রোগবালাই হয় না। পরিষ্কার খাবার আর পানি দিলে এরা সুস্থ্যই থাকে। তারপরও রোগের মধ্যে অন্যতম হল: ক্যাংকার, ঠান্ডা লাগা, চোখের ইনফেকশন, পাখি শুকিয়ে যাওয়া, হিট স্ট্রোক, এগ বাইন্ডিং ইত্যাদি। এই রোগ গুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। ভালো মানের পরিষ্কার সীড মিক্স, সফট ফুড, এগ ফুড, শাক সবজি নিয়মিত নিয়ম মাফিক দিলে লাভবার্ড সুস্থ্য থাকে।
লাভবার্ড পাখির খাবার
লাভবার্ড পাখির খাবারের তালিকা কোকাটেলের মতই। একেক জন একেক রকম সীড মিক্স ব্যবহার করে থাকেন। আপনার সামর্থ্য থাকলে বাইরের আমদানিকৃত কোকাটেলের সীড মিক্স দিতে পারেন। আর যদি নিজে সীড মিক্স বানাতে চান তাহলে নিচের অনুপাত অনুসরণ করতে পারেন:
১. ধান — ৩ কেজি
২. চিনা — ৩ কেজি
৩. মিলেট মিক্স — ২ কেজি
৪. সূর্যমূখির বীজ — ১.৫ কেজি
৫. কুসুম ফুলের বীজ ৫০০ গ্রাম
মোটঃ ১০ কেজি।
মিলেট মিক্সে ক্যানারি যত বেশি দেয়া যায় তত ভালো। এর বাইরে আপনি অন্য সীড ও দিতে পারেন। যেমন- মিষ্টি কুমড়ার বীজ, যব, গম। মোট কথা আপনার পাখি যা খেতে চাইবে সেটা যোগ করবেন আর যা খাবে না সেটা সীড মিক্স থেকে বাদ দিবেন। লাভবার্ড খুব এক্টিভ পাখি। সারা দিন ছুটোছুটি করে আর এজন্য এদের প্রচুর শক্তি খরচ হয়। এই শক্তির মূল যোগান দেয় সূর্যমূখির বীজ। কাজেই সীড মিক্সে অবশ্যই সূর্যমূখির বীজ রাখবেন। লাভবার্ডের একটা বদ অভ্যাস হল এরা প্রচুর খাবার নষ্ট করে। খাবারের অপচয় রোধ করার জন্য মাটির পাত্রে খাবার দেবেন। পাত্রের মুখে তার পেচিয়ে দেবেন যেন ওরা বাটির ভেতরে ঢুকে খাবার না ফেলে দেয়।
সপ্তাহে দুই দিন শাক সবজি, ফল দিতে পারেন। অবশ্যই ভালো ভাবে ধুয়ে দেবেন। সফট ফুড হিসেবে গম আগের রাতে ভিজিয়ে রেখে, মিষ্টি কুমড়া সিদ্ধ করে, ভুট্টা সিদ্ধ করে তাতে সেদ্ধ ডিম মিশিয়ে দিতে পারেন।
আপনার পাখি যদি সফট ফুড না খেতে চায় তাহলে আগের দিন রাতের বেলা খাবারের বাটি সরিয়ে রাখবেন। পরের দিন সকাল বেলা সফট ফুড দিবেন। সফট ফুডের উপরে একটা দুটা সূর্যমুখীর বীজ ছিটিয়ে দিবেন। সফট ফুড দুপুর পর্যন্ত রাখবেন। তারপর সীড মিক্স দিবেন। এভাবে টানা সাত দিন দিলেই পাখি সফট ফুড খাওয়া শুরু করবে।
লাভবার্ড পাখির ব্রিডিং
লাভবার্ড পাখি ব্রিড করানো অন্যতম কঠিন কাজ। এ জন্যই এদের দাম এত বেশি। যে কোন পাখিই ব্রিড করানোর জন্য ধৈর্যের দরকার। কিন্তু লাভবার্ড আপনার ধৈর্যের চরম পরীক্ষা নেবে। লাভবার্ডের বেবি করাতে চাইলে কমপক্ষে ছয় মাসের মত সময় রাখবেন।
এমন ঘটনাও আছে যে আপনার কাছে ডিম বাচ্চা করছে না বলে বিরক্ত হয়ে বন্ধু বা ছোট ভাইকে দিয়ে দিলেন বা সেল করে দিলেন। যাকে দিয়েছেন তার কাছে পরের দিনই ডিম দিয়েছে।
লাভবার্ডের মধ্যে নন রিং গুলো সহজে বেবি করে। রিং বার্ডের মধ্যে মাস্ক লাভবার্ড ভালো ডিম বেবি করে। ফিশার লাভবার্ড ডিম বেবি করতে বেশি ঝামেলা করে। বিশেষ করে ইয়েলো ফিশার।
ব্রিড করাতে চাইলে ব্রিডিং পেয়ার না নিয়ে ছয় সাত মাসের বেবি নিন। চার পাঁচ মাস আপানার কাছে থাকুক। এতে আপানার এভিয়ারির সাথে মানিয়ে নেবে। বয়স এগার বারো মাস হলে ব্রিডে দিন।
পূর্বের অভিজ্ঞতা না থাকলে নন রিং পিচ ফেস লাভবার্ড দিয়ে শুরু করা ভালো। খাচা এমন স্থানে রাখবেন যেখানে সরাসরি ফ্যানের বাতাস না লাগে। লাভবার্ড ভীতু পাখি। কাজেই কোলাহল মুক্ত, ইদুর বেড়ালের আনাগোনা নেই এমন জায়গায় খাচা রাখুন।
লাভবার্ড হাড়িতে বেবি করে। তবে বক্সে রেজাল্ট ভালো পাওয়া যায়। ব্রিডিং বক্সের মাপ 8*8*12 ইঞ্চি। লাভবার্ড বাসা বানায়, এ জন্য খাচায় নেস্টিং ম্যাটেরিয়াল দিতে হয়। নেস্টিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে খেজুর পাতা সবচেয়ে ভালো, কাটা ছাড়িয়ে খাচায় দিলে ওরা ওদের মন মত কেটে বাসা বানাবে, পাতা শুকনো বা অর্ধেক শুকনো হলেও সমস্যা নেই। খেজুর পাতা না পেলে শুকনো দূর্বা ঘাস দিন, নারিকেলের পাতাও দিতে পারেন। শনের ঝাড়ু দিতে পারেন।
নেস্টিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে পেপার না দেয়াই উত্তম। লাভবার্ড সাধারনত চারটি ডিম দেয়। সর্বোচ্চ ছয়টি দিতে পারে। এর বেশি ডিম দিলে বুঝবেন দুইটাই ফিমেল। সাধারনত ২২-২৩ দিনের মাথায় বেবি ফুটে। দেড় মাসের মধ্যে বেবি একা একা খেতে শিখে যায়।
ফিশার লাভবার্ড কলোনীতে ভালো রেজাল্ট করে। ননরিং পিচ ফেস গুলো খাচায় ভালো করে।
লাভবার্ড পাখির ব্রিডিং কোর্স
১ম ও ২য় দিনঃ Liva vet 1 ml ১ লিটার পানিতে। এই ঔষধের পানি ৪ ঘন্টা খাচায় রাখবেন। Liva Vet লিভারের জন্য উপকারী। ৪ ঘন্টা পরে ফ্রেশ পানি দিবেন।
৩য় দিনঃ Avinex ১ গ্রাম ১ লিটার পানিতে। ঔষধের পানি ২ ঘন্টা খাচার রাখবেন পরে নরমাল পানি দিবেন।
৪র্থ ও ৫ম দিনঃ Liva vet আগের নিয়মে।
এর পর ২ দিন ফ্রেশ পানি দিবেন। ২ দিন পর থেকে Calplex 2.5 ml +AD3E 1 ml ১ লিটার পানিতে ৫ দিন।
পাখি ডিম দেয়া শুরু করলে Hyprachok Amino 1 ml ১ লিটার পানিতে ৫ দিন দিবেন।
উপরের ব্রিডিং কোর্স আপনি যেকোনো পাখির জন্য ব্যবহার করতে পারেন।
লাভবার্ড পাখির মেল ফিমেল শনাক্তকরণ
সব চেয়ে কঠিন হল লাভবার্ডের মেল ফিমেল আলাদা করা। সাধারনত দুই পায়ের মাঝে পেলভিক বোনের গ্যাপ দেখে বোঝা যায়। গ্যাপ বা ফাকা বেশি হলে ফিমেল, কম হলে মেল। তাছাড়া ডালে যখন বসে থাকে তখন ফিমেল পাখি সাধারনত পা ছড়িয়ে বসে। অন্যদিকে মেল পাখি দুই পা কাছাকাছি নিয়ে বসে। আবার যদি আপনার পেয়ার আট বা তার বেশি ডিম দেয় তাহলে বুঝবেন দুইটাই ফিমেল। মেল ফিমেল সনাক্তকরনের জন্য অভিজ্ঞ কারো সহায়তা নিন।
মেটিং করলেই ওই পেয়ারের দুইটা পাখি মেল ফিমেল এমন কিন্তু না। মেল-মেল, ফিমেল-ফিমেল ও মেটিং করতে পারে। আবার যে মেল পাখি বাটি বা ডালের সাথে মেটিং করে সে মেল পাখি কখনোই ব্রিড করতে পারে না। কাজেই পাখি কেনার সময় সাবধান হতে হবে।
হাইব্রিড লাভবার্ড পাখি চেনার উপায়
লাভবার্ড ব্রিড করানোর সময় রিং আর নন রিং লাভবার্ড পেয়ার করা যাবে না। এদের যে বেবি হবে তাদের হাইব্রিড লাভবার্ড বলে। হাইব্রিড লাভবার্ড বেবি করে না। আপনি নতুন হলে পেয়ার নেয়ার সময় অবশ্যই অভিজ্ঞ কাউকে দেখিয়ে নেবেন।

উপরের ছবিটি একটা হাইব্রীড লাভবার্ডের। দেখতে পিচ ফেস লাভবার্ডের মত কিন্তু চোখের চারদিকে সাদা রিং। লাল রঙের মধ্যে হাল্কা কালো রঙ আছে। এই হাল্কা কালো রঙ দেখেই মূলত আপনি আলাদা করতে পারবেন। রিং লাভবার্ডের মধ্যে শুধুমাত্র ব্লু মিউটেশনের ঠোট সাদা রংয়ের হয়। বাকি সব গুলোর ঠোটের রঙ লাল হবে। উপরের পাখিটি গ্রিন মিউটেশনের হলেও হাইব্রিড বলে এর ঠোটের রঙ সাদা বা গোলাপী দেখাচ্ছে।
লাভবার্ড পাখির দাম
লাভাবার্ড পাখির দাম বাজরিগারের তুলনায় অনেক বেশি। এটা মূলত সহজে ব্রিড করা যায় না বলে এদের দাম এত বেশি। আবার ইম্পোর্ট করা পাখির দাম দেশি ব্রিডের চেয়ে কম।
নন রিং লাভবার্ড পাখির দাম
পিচফেস- ৩৫০০-৪০০০টাকা জোড়া
লুটিনো পিচফেস- ৪০০০ টাকা
লুটিনো পিচফেস অপালাইন-৫৫০০ – ৬০০০ টাকা
ব্লু পিচফেস- ৪০০০ টাকা

রিং লাভবার্ড লাভবার্ড পাখির দাম
ইয়েলো ফিশার, গ্রিন ফিশার- ৫০০০ – ৫৫০০ টাকা
গ্রিন অপালাইন ফিশার- ৮০০০ – ১০০০০ টাকা
পারব্লু ফিশার – ৬০০০ – ১০০০০ টাকা
ব্লু ফিশার – ৬০০০ – ৮০০০ টাকা
ব্লু অপালাইন ফিশার – ১০০০০ – ১২০০০ টাকা
লুটিনো অপালাইন ফিশার – ৫০০০০-৬০০০০ টাকা।
নতুন হিসেবে ইম্পোর্টেড লাভবার্ড পালন করা উচিৎ না। পরিচিত ব্রিডারদে কাছ থেকে পাখি নিন। সস্তা পাখি নিবেন না। সস্তার বারো অবস্থা।