আমাদের দেশে বিষয় ভিত্তিক চাকরি পাওয়া খুবই কঠিন। কিন্তু বিজ্ঞানের বিষয় গুলোর মধ্যে রসায়নে যারা অনার্স-মাস্টার্স করেছেন তাদের জন্য বিষয়টি ভিন্ন। দেশে রসায়নে পড়ুয়াদের জন্য মোটামুটি ভালোই চাকরি রয়েছে। ফার্মাসিউটিক্যালসের সংখ্যাই প্রায় ২৫০টি। এছাড়া গার্মেন্টস সেক্টরে ইটিপি, ডাইং, বা কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিও কম না। এখন তো প্রতিটি ফ্যাক্টরির জন্য ইটিপি করা বাধ্যতামূলক। আমার পরিচিত রসায়নের কোন ছাত্রছাত্রীদের পাশ করার পরে বসে থাকতে দেখিনি। পাশ করে বের হয়েই হয় ওষুধ কোম্পানির চাকরি নয়তো কেমিক্যাল কোম্পানি চাকরিতে ঢুকে পড়ে।
আগে লক্ষ্য ঠিক করুন।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দেশের স্টুডেন্টদের মাস্টার্স শেষ হওয়া মাত্র চাকরির পেছনে ছুটতে হয়। ফ্যামিলির চাপ, সামাজিক চাপ ইত্যাদির জন্য অন্য কোন দিকে মনোযোগ দেয়ার সময় থাকে না।
৯০% স্টুডেন্টদের লক্ষ্য থাকে সরকারি চাকরির। সরকারি চাকরির জব সিকিউরিটি ভালো, সামাজিক মর্যাদা আছে কিন্তু পাওয়া কঠিন। কাজেই যদি আপনার লক্ষ্য থাকে সরকারি চাকরি করার তাহলে বলব ওষুধ কোম্পানির চাকরি আপনার জন্য না। এখানে একবার ঢুকলে সরকারি চাকরির জন্য প্রিপারেশন নিতে পারবেন না। সময়ই পাবেন না।
আবার সরকারি চাকরির জন্য ট্রাই করতে করতে যদি আপনার বয়স ত্রিশ ক্রস করে যায় তাহলে ওষুধ কোম্পানির চাকরি পাওয়া আপনার জন্য কঠিন হবে। এখানে শুরুর দিকে যে ধরনের কাজ করতে দেয়া হয় সে-ধরনের কাজে ইয়াং কম বয়সী পোলাপান লাগে। যারা কথা শুনবে, ঘাউড়ামি করবে না। ওষুধ ফ্যাকটরিতে যা কিছু করা হয় সবটাই নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করা হয়। এখানে ব্যক্তিগত পছন্দ বা অপছন্দের কোন জায়গা নেই। একই কাজ দিনের পর দিন করবেন। ফ্রেশ ছেলে মেয়ে হলে তাদের এই জিনিসটা সহজে বোঝানো যায়।

১. ফার্মাসিউটিক্যালস চাকরি কেমন
প্রাইভেট যত গুলো সেক্টর আছে তার মধ্যে ফার্মা সেক্টর সব চেয়ে ডিসেন্ট এমন বলব না। তবে ফ্যাক্টরি জব যত গুলো সেক্টরে আছে তার মধ্যে ফার্মা সেরা। এখানের ওয়ার্ক এনভায়রনমেন্ট ভালো, যদি ঘাউরামি না করেন তাহলে জব সিকিউরিটি ভালো, স্যালারি রেগুলার পাবেন। যদি দক্ষ হতে পারেন তাহলে প্রমোশনের স্কোপ ভালো। ফার্মা সেক্টর ভালো না লাগলে জব চেঞ্জ করে টেস্টিং ল্যাব গুলো তে যেতে পারবেন। আপনি যদি কোন একটা ফার্মাসিউটিক্যালসে জয়েন করে কোন রকম তিন বছরের এক্সপেরিয়েন্স সিভিতে নিতে পারেন তাহলে আপনার জব নিয়ে ভাবতে হবে না। কোন না কোন ফার্মা, টেস্টিং ল্যাব আপনাকে নেবেই। তাছাড়া, ফার্মা জবে ইদানিং সামাজিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
২. তাহলে ফার্মা জবের সমস্যা কোথায়
কাজের ধরনঃ ফার্মাসিউটিক্যালসের সব কাজ নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে করতে হয়। এই নিয়ম গুলো লিখিত থাকে। প্রতিদিন, প্রতিটি কাজ করতে গেলে এই নিয়ম গুলো দেখে দেখে করতে হয়। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। ধরেন, নিয়মে আছে বোতল দশবার ঝাকাতে হবে। আপনি দেখলেন যে দুইবার ঝাকালেই মিশে যায় তারপরও আপনাকে দশবারই ঝাকাতে হবে। এটাই প্রধান সমস্যা। অনেকেই এটা করতে চায় না। না চাইলেই সমস্যার শুরু। কেউ যদি আপনাকে নাও দেখে তারপরও এটা আপনাকে করতেই হবে। নিয়ম ১০০ তে ১০০ ফলো করতে হয়। এটা মানুষের জন্য মানা কঠিন!
শিফটিং ডিউটিঃ অবশ্যই শিফটিং ডিউটি করতে হবে। মর্নিং শিফট সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা, বিকেলের শিফট দুপুর ২টা থেকে রাত ১০টা, রাতের শিফট রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত।
অভারটাইম এবং কাজের প্রেশারঃ অভারটাইম বাধ্যতামূলক (তবে ওভারটাইমের বিল পাবেন), কাজের প্রেশার কখনো কমে না।
অডিটঃ ফার্মাসিউটিক্যালসের জবের সবচেয়ে প্যারাদায়ক বিষয়। এখানকার অডিট হয় খুব কড়াকড়ি। সবাই অডিটর কে বাঘের মত ভয় পায়। অডিটের সময়টা খুবই চাপে থাকতে হয়। আপনি যদি যেকোনো ফার্মাসিউটিক্যালসের কোন এমপ্লয়িকে জিজ্ঞেস করেন তার জবের সমস্যা কোথায়? বলবে অডিটের সময়টা। যত কাজ দেন করে দিতে রাজি আছে কিন্তু অডিটের প্যারা নেয়া কঠিন হয়ে যায়।
৩. ওষুধ কোম্পানির চাকরি কাদের জন্য
ওষুধ কোম্পানি মানেই ফার্মসি সাব্জেক্টের একচেটিয়া আধিপত্য। তবে কিউসির কাজের জন্য কেমিস্ট্রির ছাত্র ছাত্রী প্রাধান্য পায়। মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ হতে হলে এইচএসসি পর্যন্ত সাইন্স লাগে।
ওষুধ কোম্পানির চাকরি দুই ভাগে বিভক্ত। হেড অফিস এবং ফ্যাক্টরি।
ফ্যাক্টরির জব গুলো হলঃ
১. প্রোডাকশন। ১০০% ফার্মেসির স্টুডেন্ট নিয়োগ পায়।
২. রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট/ প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট। ১০০% ফার্মেসির স্টুডেন্ট নিয়োগ পায়।
৩. মেথড ডেভেলপমেন্ট এন্ড ভ্যালিডেশন। ৯০% কেমিস্ট্রি, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি। ১০% ফার্মেসির।
৪. কোয়ালিটি এস্যুরেন্স। ৯৯% ফার্মেসি স্টুডেন্ট নিয়োগ পায়।
৫. কোয়ালিটি কন্ট্রোল। ৯০% কেমিস্ট্রি, এপ্লাইড কেমিস্ট্রি, বায়োকেমিস্ট্রি। ১০% ফার্মেসির। ফার্মেসির স্টুডেন্টরা সাধারণত QC তে আসে না।
৬. মাইক্রোবায়োলজিঃ ১০০% মাইক্রোবায়োলজি সাব্জেক্ট।
৭. ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট।
৮. ওয়্যার হাউজ। এখানে মিক্সড সাবজেক্ট নিয়োগ পায়। তবে কেমিস্ট্রি প্রায়োরিটি পায়।
৪. ওষুধ কোম্পানি গুলোতে কেমিস্ট্রির ছাত্র ছাত্রীদের সুযোগ কেমন
কেমিস্ট্রির স্টুডেন্টরা মূলত নিয়োগ পায় কোয়ালিটি কন্ট্রোল (QC) ডিপার্টমেন্টে। এই ডিপার্টমেন্টের কাজ হল যে ওষুধ গুলো বানানো হয় তাদের মান ঠিক আছে কিনা এবং যে কাঁচামাল দিয়ে ওষুধ বানানো হয় সেগুলোর মান ঠিক আছে কি না তা দেখা। খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব!

QC তে প্রতিদিন যে কাজ করবেন সেটা মোটা দাগে বললে কেমিস্ট্রি প্র্যাকটিক্যালের মত। বিভিন্ন ধরনের টেস্ট করতে হয়। এ জন্যই কেমিস্ট্রির স্টুডেন্টদের প্রায়োরিটি দেয়া হয়। যে pH এর কথা থিওরিতে পড়েছেন, সেই pH একজন QC তে কাজ করা লোকের দৈনিক দেখতে হয়। তেমনি প্রতিদিন বিভিন্ন দ্রবন বানাতে হয়, বিভিন্ন দ্রাবক বা সলভেন্ট নিয়ে কাজ করতে হয়। কিউসির কাজের ৯০% হল দ্রবন বা সলুশন বানানো। বিভিন্ন ক্যামিক্যালের সলুশন বানাতে হয়।
এইজন্য ফার্মাসিউটিক্যালসের কিউসির লিখিত বা ভাইভায় এইচএসসির সিলেবাসের রাসায়নিক গণনা চ্যাপ্টার থেকে প্রশ্ন বেশি হয়।
ভাইভায় কি জিজ্ঞেস করবে সেটা আগে থেকে বলা মুস্কিল। তবে ভাইভার প্রশ্নর জন্য আমাদের এই আর্টিকেল পড়তে পারেন। এগুলো যদি নিয়মিত প্র্যাকটিস করেন তাহলে রিলেটেড অন্যান্য প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। কোন প্রশ্নের উত্তর না পারলে বিনয়ের সাথে না বলবেন। নিশ্চিত না হয়ে কোন উত্তর দিবেন না। অনুমান পরিহার করবেন। যদি কোন প্রশ্নের উত্তর জানেন কিন্তু মনে করতে পারছেন না তাহলে বলুন বিষয়টি জানেন কিন্তু মনে পরছে না। ভাইভায় আপনাকে অবশ্যই বিনয়ী হতে হবে। একগুঁয়ে লোক কে কেউই পছন্দ করে না।
৫. আমার রেজাল্ট খারাপ, এতে কি কোন সমস্যা হবে
দেখুন ভালো রেজাল্টের কদর সব সময় ছিল, আছে এবং থাকবে। কিন্তু ফার্মাসিউটিক্যালস বা অন্য যেকোনো ক্যামিকেল কোম্পানির চাকরিতে রেজাল্ট কোন ফ্যাক্টর না। এমনকি ভালো রেজাল্টধারীদের অনেক সময় নিয়োগ দেয়া হয় না। কেননা, তারা দ্রুত অন্য চাকরিতে চলে যাবে। কাজেই রেজাল্ট নিয়ে ভাবাভাবির কিছু নেই। আমার জানা মতে এস কে এফ ফার্মা ছাড়া আর অন্য কোন ফার্মা রেজাল্ট নিয়ে মাথা ঘামায় না।
৬. ওষুধ কোম্পানির চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া আর কি কি যোগ্যতা লাগে
বর্তমানে যেকোনো চাকরির পূর্বশর্ত হল কম্পিউটার চালানো জানতে হবে। বিশেষ করে মাইক্রোসফট ওয়ার্ড এবং এক্সেল। প্রতিটি সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এই দুইটা সফটওয়্যার ছাড়া কোনভাবেই চলতে পারবে না। কাজেই নিজের কম্পিউটার যদি নাও থাকে তাহলে বন্ধুদের ল্যাপটপ/ডেক্সটপ যাই থাকুক না কেন লজ্জার মাথা খেয়ে শিখে নেবেন। তাছাড়া প্রতিটি কলেজে কম্পিউটার ল্যাব আছে। আড্ডাবাজি না করে সপ্তাহে তিন দিন এক ঘন্টা সময় ব্যয় করুন কম্পিউটার শিখতে।
৭. আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, কম্পিউটার চালাতে জানি, আর কি কি বিষয়ে দক্ষতা লাগবে
ইংরেজিতে কথা বলতে পারা সব সময় সব চাকরির (সরকারি বা বেসরকারি) জন্য প্লাস পয়েন্ট। আপনার পরীক্ষা যদি খারাপ হয়, ভাইভার প্রশ্নের উত্তর যদি নাও দিতে পারেন তবুও ইংরেজিতে যদি ভালো কথা বলতে পারেন তাহলে আপনি অবশ্যই এগিয়ে থাকবেন। আপনার চাকরির অভাব হবে না। ফার্মাসিউটিক্যালস বলেন আর অন্যান্য যে সেক্টরের কথাই বলেন না কেন, সব খানেই ইন্ডিয়ান ম্যানেজমেন্ট কাজ করে। ওরা ইংরেজি কে সব সময়ই প্রয়োরিটি দেয়।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে চাকরি করার সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল ভাইভা নেয়ার। আমি লক্ষ্য করেছি ক্যান্ডিডেটরা কথা বলতে পারেন না। স্বাভাবিক কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিতে পারেন না। বিষয় ভিত্তিক প্রশ্ন না পারলেও শুধুমাত্র কথা বলতে পারেন এমন ক্যান্ডিডেট নিয়োগ বেশি পান। অর্থাৎ চোখ কান খোলা এমন প্রার্থী চান নিয়োগকর্তা। এধরনের প্রার্থীদের পরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা সহজ হয়। এ জন্য নিয়মিত পেপার পড়ার কোন বিকল্প নেই। বিশেষ করে প্রথম পাতা, আন্তর্জাতিক ও মতামত এই তিনটা পাতার সংবাদ অবশ্যই পড়া উচিৎ।
শেষ কথা হল, আপনি যদি সত্যিই চাকরি করতে চান তাহলে নিজেকে প্রস্তুত করুন। বিনা প্রস্তুতিতে চাকরি পাওয়া কঠিন।