বেশ কয়েক বছর থেকে আলোচিত শব্দ ফ্রিল্যান্সিং। অনেকের কাছেই শুনেছেন ওমুক ইন্টারনেটে ফ্রিল্যান্সিং করে টাকা ইনকাম করছে। ঘটনা কিন্তু সত্য।
তাহলে ফ্রিল্যান্সিং কি এবং কেন করব? মনে করুন আপনি বেশ ভালো লেখালেখি করেন। ফেসবুকে আপনার পোস্টের সবাই প্রশংসা করে। আপনার বাড়ি টেকনাফ। এদিকে আমার একটা এসাইনমেন্ট জমা দিতে হবে শাহ আব্দুল করিমের গানের উপর। কিন্তু আমি ভালো লিখতে পারি না। আমার বাড়ি পঞ্চগড়।
আমি ফেসবুকের জনপ্রিয় কোন একটা গ্রুপে পোস্ট দিলাম, যে আমার এসাইনমেন্ট লিখে দিবে তাকে আমি প্রতি এক হাজার শব্দের জন্য ৫০০/- করে দিব। আপনিও গ্রুপে আছেন, আমার পোস্ট দেখে আমাকে মেসেঞ্জারে জানালেন যে আপনি কাজটা করতে ইচ্ছুক। আপনার লেখার হাত ভালো এর প্রমাণ সরুপ কয়েকটি পোস্টের লিংক শেয়ার করলেন।
আমি দেখলাম যে আপনি আসলেই ভালো লিখেন। কাজটা আপনাকে করতে দিলাম। ৩ দিনের মধ্যে করেদিবেন এই শর্তে। আপনি ৩দিনের মধ্যেই ২০০০ শব্দের একটা এসাইনমেন্ট আমাকে করে দিলেন। বিনিময়ে ১০০০/- পেলেন। ব্যাস, আপনি হয়ে গেলেন ফ্রিল্যান্সার। আর এই পুরো প্রসেসটা হল ফ্রিল্যান্সিং।
আপনি নির্দিষ্ট কোন মালিকের অধীনে কাজ করলেন না। স্বাধীন ভাবে আপনার দক্ষতা দিয়ে অন্যদের কাজ করে দিলেন – এটাই ফ্রিল্যান্সিং। লেখালেখি, ডাটা এন্ট্রি, টাইপ করে দেয়া, ডিজাইন করে দেয়া, কম্পিউটার রিলেটেড কাজ, ওয়েবসাইট ডিজাইন, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ফেসবুকে মার্কেটিং- এরকম শত শত ধরনের কাজ আপনি করে দিতে পারবেন। অনলাইন বা ইন্টারনেটে এই ধরনের কাজ করে ইনকাম বা আয় করাই ফ্রিল্যান্সিং বা অনলাইনে আয় করা বোঝায়।
আমি ফ্রিল্যান্সিং করতে চাই, কীভাবে শুরু করব
ফ্রিল্যান্সিং করে ডলার ইনকাম করা যায় এটা শুনেই বেশির ভাগ মানুষের মনে প্রথম এই প্রশ্নটাই উঁকি মারে। আগেই বলেছি, বিভিন্ন ধরনের কাজ মার্কেটপ্লেস (মার্কে্টপ্লেস বলতে যে ওয়েবসাইট গুলোতে ফ্রিল্যান্সিং কাজ গুলো পাওয়া যায়, যেমন ফাইভার বা আপওয়ার্ক) গুলোতে পাওয়া যায়। আপনি আগে মার্কেট প্লেসে গিয়ে দেখুন কোন কাজটা আপনি করতে পারবেন বা আপনার ভালো লাগে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা ধাপ!
মার্কেট প্লেসে গিয়ে দেখবেন যে বেশির ভাগ কাজের কোন আগা মাথা আপনি বুঝতে পারছেন না। ওয়েবসাইট ডিজাইন আর ডেভেলপমেন্ট এর কাজ প্রচুর। কিন্তু এই দুইটা শব্দ হয়তো আজই প্রথম দেখলেন। আপনি হতাশ হয়ে যাবেন কিছুক্ষণের মধ্যে! ফ্রিল্যান্সিং করতে গিয়ে হতাশ হওয়া যাবে না কোন ভাবেই। এই সেক্টরটি পুরোপুরি ধৈর্যশীলদের জন্য।
ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ গুলো সবই ডিজিটাল কাজ। অর্থাৎ কম্পিউটারের কাজ। আর আমরা কম্পিউটারে লেখালেখি, মুভি দেখা বা গান শোনা, ফেসবুকিং করা বা ইউটিউব দেখা ছাড়া আর কিছু করি না। কাজেই মার্কেট প্লেসে যে কাজ গুলো দেখবেন সেগুলো আপনাকে শিখতে হবে। শুধু শিখলেই হবে না আপনাকে দক্ষ হতে হবে। কেননা একটা কাজের জন্য অনেকেই আগ্রহী হবে। তাদের মধ্যে যে সব চেয়ে দক্ষ তাকেই কাজ টা দেয়া হয়। এখানে মামা খালুর সুপারিশ করার সুযোগ নেই।
ফ্রিল্যান্সিং কাজ শিখতে আপনার কত দিন লাগবে?
কমপক্ষে ছয় মাস। তাও যদি দৈনিক ৩-৫ ঘন্টা সময় দেন তাহলেই সম্ভব। এত ধৈর্য্য ৯০% মানুষের নেই।
ধরে নিলাম আপনার ধৈর্য্য আছে, তাহলে বলব কাজ শিখুন। ভালো কোন ট্রেনিং সেন্টার থেকে কাজ শিখুন। বাংলাদেশে হাজার হাজার এই ধরনের ট্রেনিং সেন্টার আছে। তাদের অনেকেই তিন মাসেই আপনাকে হাজার হাজার ডলার ইনকাম করার মত ট্রেনিং দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিবে। এমনকি ৭ দিনেও আয় করার গ্যারান্টি দিবে। এ ধরণের ট্রেনিং সেন্টার গুলো এড়িয়ে চলবেন। ছয় মাস ট্রেনিং নিলে, মোটামুটি বুঝে যাবেন কীভাবে কি হয়!
যদি ট্রেনিং সেন্টারে যেতে না চান, তাহলে ইউটিউব চ্যানেল থেকে শিখুন। কিন্তু এটা বেশ কঠিন। কিছু কিছু জিনিস কেউ একজন দেখিয়ে বা বুঝিয়ে না দিলে শেখা কঠিন। তাছাড়া একজন মেন্টর ছাড়া এই লাইনে সফল হওয়াও কঠিন। যে কাজ শিখবেন সে কাজ রিলেটেড ফেসবুক গ্রুপে এড হয়ে নিন। গ্রুপ গুলো তে বেশ ভালো হেল্প পাওয়া যায়।
হুটহাট কোন ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হবেন না। দেখে শুনে ধীরে সুস্থে ভর্তি হোন। ফেসবুকের কমেন্ট আর রিভিউ দেখে বিভ্রান্ত হবেন না। কমেন্ট আর রিভিউ কিনতে পাওয়া যায়। আবার অনেক ফেসবুক গ্রুপ থেকে অন্যের বিভিন্ন কোর্স ভিডিও কম দামে কিনতে পাওয়া যায়। এটা আমার মতে নৈতিকভাবে ঠিক না। তাছাড়া যখন কোন ভালো ট্রেনারের কাছ থেকে শিখবেন, সেই ট্রেনার আপনার মেন্টর হিসেবেও কাজ করবে। ফ্রিল্যান্সিং এ মেন্টরের গুরুত্ব অনেক, বিশেষ করে নতুনদের জন্য।
মোটামুটি কম সময়ে ইনকাম করতে চাইলে নিচের কাজ গুলো শিখতে পারেন-
ডিজিটাল মার্কেটিং
SEO বা সার্চ ইঞ্জিন অপটিমাইজেশন
ওয়ার্ডপ্রেস ওয়েবসাইট কাস্টমাইজেশন
কন্টেন্ট রাইটিং
ব্লগিং
ইউটিউবিং
আর হ্যা, ফ্রিল্যান্সিং এ ভালো করতে হলে আপনাকে অবশ্যই ইংরেজিতে ভালো হতে হবে। কেননা, ফ্রিল্যান্সিং এর সব কিছু ৯৯% ইংরেজিতে হবে। কিছু কিছু মার্কেটপ্লেসে আপনাকে ইংরেজি দক্ষতা প্রমানের জন্য পরীক্ষাও দিতে হবে।
যদি ইংরেজি না জানেন তাহলেও অনলাইন থেকে আয় করা যায়। সেটা অন্য একটা আর্টিকেলে বিস্তারিত লিখেছি। তবে কিছুটা ইংরেজি জানতে হবেই।
মোবাইলে ফ্রিল্যান্সিং করব কীভাবে
অনেকের কম্পিউটার কেনার সামর্থ্য থাকে না। সেক্ষেত্রে মোবাইল ব্যবহার করে ফ্রিল্যান্সিং করা যাবে কি না? কিছু কিছু কাজ আপনি মোবাইলে করতে পারবেন। যেমন এই আর্টিকেল সহ আমার ওয়েব সাইটের বেশির ভাগ আর্টকেল মোবাইলে লেখা। অর্থাৎ কন্টেন্ট রাইটিং এর কাজ মোবাইলে করতে পারবেন। ইউটিউবে আয় করতে চাইলে মোবাইল দিয়েই করা সম্ভব। তেমনি ফেসবুকে ভিডিও শেয়ার করে আয় করতে চাইলে সেটাও মোবাইল দিয়ে করা সম্ভব। তবে আলটিমেটলি আপনাকে কম্পিউটার নিতে হবেই।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ফ্রিল্যান্সারদের ভবিষ্যৎ কেমন?
২০২০-২০২১ অর্থ বছরে ফ্রিল্যান্সিং থেকে বাংলাদেশীরা ২০০ কোটি টাকার উপরে আয় করেছে। এটা বাড়ছেই। বর্তমানে আমরা চতুর্থ বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি যা ইন্টারনেট বিপ্লব নামে পরিচিত। সবকিছু এখন অনলাইনে করতে হয়। ইন্টারনেট থাকলে ফ্রিল্যান্সিং থাকবে। কাজেই ফ্রিল্যান্সিংয়ের ভবিষ্যৎ ভালো।
ফ্রিল্যান্সিং এর ভালো আর খারাপ দিক কোন গুলো
ভালো দিক গুলো আগে বলিঃ
১. কাজের স্বাধীনতা। আপনার কোন বস নেই। যখন যার জন্য কাজ করবেন তখন সে আপনার বস।
২. ভালো কাজ জানলে বেশ ভালো আয় করা যায়। সেটা লাখের উপরেও অহরহ হয়। এমন অনেককে চিনি যারা ব্যস্ততার জন্য নতুন কাজ হাতে নিতে চায় না। অন্যকে দিয়ে করিয়ে নেয়।
৩. কাজ যেকোনো জায়গায় থেকে করা যায়। ফলে যারা হোমসিক বা নিজ বাড়ি থেকে দূরে যেতে চাননা তাদের জন্য বেশ ভালো অপশন।
খারাপ দিকঃ
১. আমাদের দেশে এখনো সামাজিক স্বীকৃতি সেভাবে নাই। বিয়া করতে গেলে ঝামেলায় পড়বেন।
২. রাত জাগতে হবে। যেহেতু বিদেশি ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করবেন, আর বাইরের সাথে আমাদের টাইম টেবিল বিপরীত সুতরাং রাত জাগা ছাড়া উপায় নাই।
৩. বাসায় থেকে কাজ করার জন্য বাসার লোকজন ভাবে সারাদিন বসে বসে সময় নষ্ট করছেন। এমনকি আপনি কাজে ব্যস্ত থাকলেও দেখবেন বলবে বসেই তো আছিস, একটু বাজারটা করে আনলে কি এমন ক্ষতি হবে।
৪. প্রচুর প্রতিযোগিতা। নিজেকে দক্ষ না রাখলে, আপডেট না রাখলে পিছিয়ে যাবেন। পিছিয়ে পড়া মানে কাজ পাবেন না।
বসে থাকার চেয়ে বা চাকরির পেছনে ছুটতে ছুটতে হয়রান হওয়ার চেয়ে অনেক ভালো অপশন ফ্রিল্যান্সিং। স্বাধীন ভাবে কাজ করবেন।
ফ্রিল্যান্সিং এর কাজ কোথায় পাওয়া যায়। Top 10 freelancing marketplace

এর জন্য অনেক ওয়েবসাইট আছে। যেখানে এই কাজ গুলো পাওয়া যায়। জনপ্রিয় কিছু সাইটঃ
upwork.com
freelancer.com
fiverr.com
peopleperhour.com
99design.com
toptal.com
flexjobs.com
linkedin.com
behance.com
dribbble.com
simplyhired.com
taskrabbit.com
এছাড়া আপনার তোলা ছবি shutterstock.com সাইটে আপলোড করে রাখতে পারেন। কেউ যদি ঐ ছবি কিনে তাহলে আপনি ডলার পাবেন। বাংলাদেশে কিছু ফেসবুক গ্রুপ থেকেও কাজ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সাইট গুলোতে একাউন্ট করতে যাবেন না। এতে তালগোল পাকিয়ে ফেলবেন। আগে কিছু কাজ শিখুন, তারপর সাইট গুলোতে একাউন্ট খুলুন। বিভিন্ন কাজ দেখুন। অন্যান্য ফ্রিল্যান্সাররা কিভাবে কাজ পাচ্ছে, তাদের যোগ্যতা কি, দক্ষতা কি এগুলো দেখুন। তারপর তাদের মত করে নিজেকে প্রস্তুত করুন। বেশিরভাগ নতুনরা কিছু কাজ শিখেই মার্কেটপ্লেস গুলোতে কাজ করতে যায়। ফলে তারা কাজ পায় না। পেলেও সঠিক সময়ে শেষ করতে পারে না, কাজের কোয়ালিটি ভালো হয় না। এতে তার প্রোফাইলে নেগেটিভ রিভিউ পরে যায়।
কোন সাইটে একাউন্ট খোলার আগে সেই সাইটের নিয়ম কানুন ভালো করে বুঝে নিবেন। নয়তো আপনার একাউন্ট ব্যান হতে পারে।
নতুনদের ফ্রিল্যান্সিং এর জন্য পরামর্শ
১. কম্পিউটার/ল্যাপটপ আছে মানেই আপনি ফ্রিল্যান্সিং করতে পারবেন এমন না। অনেক অনেক ধৈর্য ধরতে হবে। আগে কাজ শিখুন তারপর মার্কেটপ্লেসে গিয়ে কাজ পাওয়ার চেষ্টা করবেন।
২. ৭ দিন, ৩০ দিনেই ইনকাম করার অফার যারা দিবে তাদের থেকে দূরে থাকবেন। এত অল্প সময়ে কোন ভাবেই ভালো করা সম্ভব না।
৩. নতুন অবস্থায় কাজ পেতে সময় লাগবে। নতুনদের কাজ দিতে চায় না কেউ। সেক্ষেত্রে কয়েকজন কে ফ্রি কাজ করে দিন। সেই কাজের লিংক শেয়ার করুন।
৪. অনলাইনে দ্রুততম সময়ে আয় করার সুযোগ হল ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করা। খুব বেশি আয় হবে এমন না। কিন্তু হাত খরচ উঠে আসে। পাশাপাশি অন্যান্য কাজ গুলো শিখলেন। এতে হতাশ হয়ে যাবেন না। পকেটে টাকা থাকলে হতাশা আসে না।
৫. কোন কাজের অর্ডার যখন নিবেন তখন ভালো করে বুঝে নিবেন। সময় মত কাজ ডেলিভারি দিবেন। এতে আপনার ক্লায়েন্ট আপনাকে ভালো রিভিউ দিবে। এমনি পরবর্তীতে আবার আপনার কাছে থেকেই কাজ করিয়ে নেবে। যে কাজ সময় মতো করতে পারবেন না সে কাজ নিবেন না। নেগেটিভ রিভিউ মানে বাঁশ খাওয়া।
ফ্রিল্যান্সার হতে চাইলে কাজ শেখার কোন বিকল্প নাই। সাথে দক্ষও হতে হবে। আপনার দক্ষতা থাকলে ফ্রিল্যান্সিং করে বেস ভালো ডলার আয় করা সম্ভব।